দক্ষিণ এশিয়া বিশ্ব রাজনীতিতে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ; চীনের কাছে তো অবশ্যই। বলা হয়, নিজেদের ‘ব্যাক ইয়ার্ড’ হিসেবে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রাখে বেইজিং। তবে এটা শুধু যোগাযোগ রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাকি ভারতকে সরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার চালকের আসনে নিজেদের বসার কৌশল, সেটা সময়ই বলে দেবে।
আফগানিস্তানে ক্ষমতার রদবদল এটা বেশ সহজ করে দিয়েছে চীনের জন্য। পাশাপাশি করোনাসহ বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি ভারতের অবন্ধুসুলভ আচারণ, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের পাশ কেটে চলার নীতি, চীনের এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য ক্ষেত্র একপ্রকার প্রস্তুত করেই দিয়েছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সাথে তিস্তা ও সিন্ধুর পানিবন্টন নিয়ে ক্রমাগত দাদাগিরি করে, কাশ্মীরে চালানো কয়েক দশকের নির্মম অত্যাচার ও বাংলাদেশ সীমান্তে স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে, রাজনীতির নামে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে ভারত নিজেদের জন্য খাল কেটে কুমির নিয়ে এসেছে।
চীনও কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে সম্পর্ক উন্নয়নে। সূত্র মতে, সম্প্রতিই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই একই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করবেন। কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে হবে এ বৈঠক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনসহ আফগানিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন।
একাধিক সফরে চীন-বাংলাদেশ
কূটনৈতিক সূত্র মতে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুুল মোমেন তাৎপর্যপূর্ণ এক সফরে বেইজিং যাচ্ছেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েং ই’র বিশেষ আমন্ত্রণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সফরটি হচ্ছে।
মন্ত্রী মোমেন গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, হ্যাঁ, চীন যাবো, উনারা আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন, আমি গ্রহণ করেছি। এখন সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় আছি। কবে নাগাদ সফরটি হতে পারে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এখনো তারিখ চূড়ান্ত হয়নি, তবে খুব তাড়াতাড়ি যাবো। দুই পক্ষের আলাপ-আলোচনা চলছে। উভয়ের সুবিধাজনক সময় খোঁজা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তরান্বিত করতে দু’এক মাসের মধ্যে চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি বৈঠক হতে পারে।
এদিকে, চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল উই ফেংগেও একদিনের সফরে মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) ঢাকা আসছেন। একই দিনে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী বৈঠক করবেন বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে।
তাছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তরান্বিত করতে দু’এক মাসের মধ্যে চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি বৈঠক হতে পারে। ত্রিদেশীয় ওই রুটিন বৈঠকটি করোনা এবং মিয়ানমার পরিস্থিতির কারণে ঝুলে আছে দেড় বছর ধরে। দ্রুত বৈঠকটি আয়োজনে তাগিদ দিয়ে চলেছে ঢাকা। তাসখন্দ বৈঠকে বেইজিংয়ে ফিজিক্যালি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও চীন। এখন মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বের ইতিবাচক সাড়ার অপেক্ষায় দুই দেশ।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চীন সফর
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি সম্প্রতি চীন সফর করেছেন। এক রহস্যময় সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ জন চীনা শ্রমিক নিহত হওয়ার পর এ সফর অনুষ্ঠিত হয়। শাহ মাহমুদ কুরেশি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের আমন্ত্রণে শুক্র ও শনিবার চীন সফর করেন। গত শুক্রবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র অফিস (এফও) ঘোষণা করে, কুরেশির সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিলেন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সফরকালে উভয় পক্ষ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর করার বিষয়ে আলোচনা হয়। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিসি) এর অধীনে সম্পর্ক উন্নয়নে সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী বিষয়ে আলোচনা করবে এবং পারস্পরিক স্বার্থ, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়েও আলেচনা হয়।
সূত্র মতে, এ সফর পাকিস্তান-চীনকে ‘অল-ওয়েদার স্ট্র্যাটেজিক কো-অপারেটিভ পার্টনারশিপ’ আরো জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং বেইজিংয়ের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে কৌশলগত যোগাযোগ ও সমন্বয় বাড়িয়ে তুলবে।
টাকা নিলো, টিকা দিলো না
চুক্তির পর ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে দু’টি চালানে ৭০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশ পেয়েছে গত জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে। এছাড়া ভারত সরকার উপহার হিসাবে দিয়েছে ৩২ লাখ ডোজ।
কিন্তু সূত্র মতে, বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি কোম্পানি বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি টিকা কেনার চুক্তি করেছিল। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা পাওয়ার কথা ছিল।
এরপর ভারতের কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী করোনার টিকার পরের চালান কবে আসবে, সেই নিশ্চয়তা জানাতে বাংলাদেশের অনুরোধের জবাবে ভারত গত এপ্রিলে এক কূটনীতিক পত্র পাঠায়; তাতেও সেই অনিশ্চয়তা তো দূর হয়নি। বরং ভারত বাংলাদেশকে টিকা রপ্তানি আপাতত স্থগিত করারই ইঙ্গিত দেয়।
জানা যায়, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটকে দেড় কোটি ডোজ টিকার জন্য অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু টিকা এসেছে ৭০ লাখ ডোজ। এখনো ৮০ লাখ ডোজ টিকা সেরাম ইনস্টিটিউট দেয়নি।
সীমান্ত হত্যা নিয়ে খামখেয়ালি
সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলেও, কখনও ভারত তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সীমান্ত হত্যা বন্ধের আশ্বাস দিয়েও তারা নির্বিচারে হত্যা করেছে বাংলাদেশিদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো স্রেফ হত্যাকাণ্ড।
তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদলু এজেন্সির ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে থেকে জানা যায়, মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কমপক্ষে ১,১৮৫ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ।
দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধ আলোচনা, চুক্তি হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায়ও কোনও সমাধান আসেনি। ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ পর্যায়ে সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার করবে না দুই দেশ, এমন চুক্তি হলেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা৷
এরপর সীমান্তে হত্যা বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও হয় দুই দেশের মধ্যে। সেখানে সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করতে একমত হয় দুই দেশ। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন দেখা যায়নি সীমান্তে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, গত বছর সীমান্তে মোট ৪৮ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ৷ এর মধ্যে ৪২ জনকে গুলি করে এবং ছয় জনকে হত্যা করা হয় নির্যাতন চালিয়ে৷ অপহরণ করা হয় ২২ বাংলাদেশিকে৷
সীমান্তে হত্যা বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও হয় দুই দেশের মধ্যে। সেখানে সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করতে একমত হয় দুই দেশ। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন দেখা যায়নি সীমান্তে।
ওই সময়ে ২৬ জন বিএসএফ-এর গুলি ও নির্যাতনে গুরুতর আহত হন৷ অপহৃতদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনকে ফেরত দেয়া হয়েছে৷ বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে জানা যায়নি৷
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু, বাস্তবতা তা বলে না। বেশ কয়েক বছর আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে একটি প্রতিবেদনে এ ধরনের বেশ কয়েকটি মামলার উল্লেখ করেছে। যাতে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন যে বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। বিএসএফ আরও দাবি করেছে যে দুর্বৃত্তরা গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করলে তাদের সদস্যরা গুলি চালায়। তবে কোনও অপরাধের সন্দেহে প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত হয় না।
এইচআরডাব্লিউ, অধিকার ও এএসকের প্রতিবেদন এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে অপরাধী হিসেবে সীমান্তে হত্যার শিকার ব্যক্তিরা হয় নিরস্ত্র থাকে অথবা তাদের কাছে বড়জোর কাস্তে, লাঠি বা ছুরি থাকে।
তিস্তা নিয়ে ছেলেখেলা
তিস্তা অববাহিকার ৫ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এই নদীর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই তিস্তার পানির প্রবাহ কমে যাওয়া আমাদের জীবন ও জীবিকায় আঘাতস্বরূপ। তিস্তা অববাহিকার ৮ হাজার ৫১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। আর সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকার পরিমাণ ৪ হাজার ১০৮ বর্গ কিলোমিটার, যার প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়।
দুই দেশই তিস্তার পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময়ে নদীর ওপর ও আশপাশে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে। ভারত এই মুহূর্তে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রমের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ তিস্তার পানি ব্যবহার করছে শুধু পরিকল্পিত সেচ দেওয়ার কাজে।
যদিও গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি ক্রমাগত কমে গেছে। এর দরুন তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১২টি উপজেলা যথা- ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী সদর, সৈয়দপুর, রংপুর সদর, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, গঙ্গাচরা, পার্বতীপুর, চিরিরবন্দর ও খানসামা, যারা তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি জমিতে সেচসুবিধা পেয়ে থাকে, তাদের কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
ভারত তার ৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমির সেচের চাহিদা মিটিয়ে যে পরিমাণ পানি ছাড়ে, তা দিয়ে বোরো মৌসুমে আমাদের সেচ চাহিদার অর্ধেকও পূরণ করা যায় না।
১৯৯৭ সালে বাংলদেশে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানির প্রবাহ ছিল প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কিউসেক, যা ২০০৬ সালে নেমে আসে ১ হাজার ৩৪৮ কিউসেকে এবং ২০১৪ সালে পানির প্রবাহ এসে দাঁড়ায় মাত্র ৭০০ কিউসেক, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সিন্ধু নদে ভারতের দাদাগিরি
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যে ১৯৬০ সালে এক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মীরের মোট ছয়টি নদী দুই দেশের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। ঠিক হয়, পশ্চিম দিকের তিন নদী সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও ঝিলমের পানি পাকিস্তানে যাবে, পূর্ব প্রান্তের তিন নদী বিপাশা, ইরাবতী ও শতদ্রুর পানি পাবে ভারত।
চুক্তি অনুসারে পাকিস্তান, পশ্চিমের নদীসমূহ যেমন ঝিলম, চেনাব এবং সিন্ধু, যা ভারতে উৎপন্ন হয়ে পাকিস্তানে প্রবাহিত হয়েছে, এগুলির উপর পূর্ণ অধিকার উপভোগ করে। ভারতের কোনও ক্ষমতা নেই, এই সব নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করে পাকিস্তানকে এদের জল থেকে বঞ্চিত করার।
পানি নিয়ে পাকিস্তানের জীবন-মরণ সমস্যা হঠাৎ তৈরি হয়নি। প্রয়োজন ও জোগানের ব্যবধান সামনে রেখে কার্যকর কোনো পানি পরিকল্পনা নেই দেশটিতে। দেশটি প্রতিবছর প্রকৃতি থেকে যে পানি পায়, তার মাত্র ১০ ভাগ ধরে রাখার সামর্থ্য তার আছে।
তবে অনেক রাজনীতিবিদ মনে করেন, সংকটের মূলে রয়েছে ভারতের বৈরী আচরণ। বিশেষত দুই দেশের মধ্যে ১৯৬০ সালে সম্পাদিত পানি চুক্তি ভারত লঙ্ঘন করে কাশ্মীর অঞ্চলে একের পর এক ড্যাম তৈরি করছে বলে পাকিস্তানের অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে কাশ্মীর সীমান্তের ভারতীয় ‘কৃষানগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’-এর উদাহরণ দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদি গত মে মাসে সেটি উদ্বোধন করেন। এ প্রকল্প নির্মিত হয়েছে ঝিলাম নদীর শাখা নিলমের প্রবাহে। এটা পাকিস্তানে পানিসংকটের একটি কারণ হয়েছে।
কৃষানগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প উদ্বোধনের সময়ই কিস্তোয়ার জেলায় চেনাবের একটি শাখানদীতে ভারত তিন গুণ বড় আরেকটি ড্যাম প্রকল্প (‘পাকুল দুল’ নামে পরিচিত) শুরুর ঘোষণা দেয়। কাশ্মীরের ভারতীয় ড্যামগুলো নিশ্চিতভাবেই কারাকোরাম-হিমালয় অঞ্চল থেকে সিন্ধু অববাহিকায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে এবং এরূপ প্রতিবন্ধকতা বাড়াতে নিজের আগ্রহ নয়াদিল্লি গোপন করার চেষ্টাও করছে না।
কাশ্মীরে ৭০ বছরের অপশাসন
ভারতশাসিত কাশ্মীরের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, গত ২৮ বছরে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে যাদের নির্যাতন করা হয়েছে, তাদের ৭০ শতাংশই সাধারণ নাগরিক।
চারশো জনেরও বেশি নির্যাতিত ব্যক্তির লিখিত জবানবন্দীর ওপরে ভিত্তি করে তৈরি তাদের এক প্রতিবেদনে যৌনাঙ্গে মরিচের গুঁড়ো দেয়া, লোহার শিক ঢোকানো বা হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখার মতো নির্যাতনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
কাশ্মীর কোয়ালিশন অব সিভিল সোসাইটিজ নামে এই সংগঠনটি বলছে, ১৯৯০ সাল থেকে সেনাসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী যে ভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে তা ‘অভাবনীয়।’
নির্যাতিতদের মধ্যে উগ্রপন্থী বা সাবেক উগ্রপন্থীরা আছে ঠিকই; কিন্তু ৭০ শতাংশই হচ্ছে সাধারণ বেসামরিক নাগরিক। সংগঠনটির প্রধান পারভেজ ইমরোজ বিবিসিকে বলছিলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হবার পর লোকজনের নিখোঁজ হওয়া বা নিরাপত্তা হেফাজতে মুত্যুর ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট হয়েছে; কিন্তু নির্যাতনের ঘটনাগুলো নিয়ে রিপোর্ট হয়নি। কিন্তু তথ্য ঘাঁটতে গিয়ে দেখা গেছে এরকম হাজার হাজার ঘটনা রয়েছে।
নির্যাতনের শিকার হওয়া ৪৩২ জনের লিখিত বিবৃতি সংগ্রহ করেছে সংগঠনটি। তারা যে সব নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন তার মধ্যে চড়-থাপ্পড়, লাথি, গালিগালাজ যেমন আছে, তেমনি আছে যৌনাঙ্গে বিদ্যুতের শক দেয়া, মলদ্বারে মরিচের গুঁড়ো বা লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়া, উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা বা নগ্ন করে তল্লাশির মত ঘটনা।
এছাড়া ৫ আগস্ট ২০১৯ সালে, ভারত সরকার সংবিধানের সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে প্রদত্ত বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে। এরপর উপত্যকাটির সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করা হয় এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল।
এরপর ভারতের অধিকৃত কাশ্মীর হয়ে ওঠে বিশ্বের একমাত্র খোলা কারাগার। এক মৃত্যু উপত্যকা। টানা কারফিউ, নিরাপত্তার নামে কড়া অবরোধ। হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বন্ধ।খাবার ফুরিয়ে যাওয়া, চিকিৎসার অভাবে প্রসূতিদের ছটফট। রাস্তায় রাস্তায় টহল, একটু পরপর ব্যারিকেড। খাঁচাবন্দি ছিল প্রায় ৮০ লাখ বাসিন্দা।
বিক্ষোভ-সমাবেশে পেলেট বা ছররা গুলি ছুড়ে অন্ধ করে দেয়া হয় কাশ্মীরিদের। বাড়ি বাড়ি চলে তল্লাশি। রাতের আঁধারে তুলে নেয়া হয় তরুণ-যুবকদের। থানা আর সেনা ক্যাম্পে নিয়ে চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়ন। বিশ্লেষকরা জানায়, মূলত ঢালাও গ্রেফতার, গুম, হত্যা আর অস্বীকারের খেলা- এই চার অস্ত্রে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পুরো উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল পদক্ষেপ ও উপত্যকাজুড়ে কারফিউ-অবরোধ আরোপের পরই কাশ্মীরিদের ওপর ঢালাও আটক-গ্রেফতার শুরু হয়। খ্যাতনামা রাজনীতিক, নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, সাংবাদিক, দিনমজুর কেউই বাদ যাচ্ছে না।
এএফপি জানায়, সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই চার হাজারের বেশি মানুষকে আটক করা হয়। কাশ্মীরের কারাগারগুলোতে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যের কারাগারগুলোতে।
আপনার মতামত জানানঃ