“বর্ষা এলে উচ্ছেদ চালিয়ে পাহাড় কাটা থামানো যাবে না। দু’মাস উচ্ছেদ হয়, আর পাহাড় কাটা চলে ১০ মাস। এভাবে আরো কয়েক বছর চললে নগরীতে আর পাহাড়ের অস্তিত্বই থাকবে না”, বলেন পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েস এর সভাপতি শরীফ চৌহান।
বর্ষা এলেই উচ্ছেদ। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে সরিয়ে নেয়া হয় বসতি স্থাপনকারীদের। এটাই আমাদের ‘পাহাড় রক্ষা’। যদিও শুধু বর্ষাকেন্দ্রিক এসব তৎপরতায় চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষা ‘সম্ভব নয়’ বলেই মনে করেন পরিবেশবিদরা। এদিকে পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতা চলছে। অবৈধ দখলকারীদের পাশাপাশি সরকারি সংস্থাও উন্নয়ন কাজের জন্য কাটছে পাহাড়। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা তাতে দীর্ঘ হচ্ছে; সঙ্গে বাড়ছে বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা।
পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন
প্রায় ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা ট্রাংক রোডের ফৌজদারহাট অংশ থেকে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণে দুই পাশে ৯০ ডিগ্রি খাড়া করে পাহাড় কাটে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এভাবে কাটায় এখন যে কোনো সময় পাহাড়গুলো ধসে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড নির্মাণে সিডিএ কেটেছে ১৮টি পাহাড়। এসব কাটা পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা সাড়ে তিনশর বেশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদও করা হয় গত বছর। কিন্তু সেখানে নতুন করে আরও স্থাপনা হয়েছে।
২০১৯ সালে প্রশাসনের করা তালিকার ১৭টি পাহাড়ের মধ্যে ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং বাকি সাতটি সরকারি বিভিন্ন সংস্থার। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, গণপূর্ত এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের পাহাড় রয়েছে।
সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন এসব পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা ৮৩৫টি পরিবারের তালিকা হয়েছিল এক সময়। সে বছর উচ্ছেদ হয় ৩৫০টি পরিবার। বাকি থাকে আরও ৪৮৫টি। এরপর গত বছর শুরু হয় করোনা ভাইরাস মহামারী। এর মধ্যেই চলতে থাকে নগরীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটা। বাড়ে বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা।
১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা করার পর গত দুই বছরে তাতে যুক্ত হয়েছে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের আরও আটটি ছোট-বড় পাহাড়। তাই ঝুঁকিতে থাকা পাহাড়ের সংখ্যা এখন ২৫টি।
মামলা চলছে অথচ পাহাড় কেটে দেয়া হচ্ছে ঘর ভাড়া
নগরীর ফিরোজ শাহ এবং বাটালি হিলের নিচের মতিঝর্ণা, এই দুটি এলাকায় উচ্ছেদ বন্ধে আদালতে রিট মামলা চলছে। এ প্রসঙ্গে পাহাড়ের অবৈধ বসতিতে সেবা সংস্থার সংযোগ নির্ধারণে গঠিত সাব কমিটির আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক নুরুল্লাহ নূরী বলেন, ফিরোজ শাহ ও মতিঝর্ণার পাহাড়ে প্রায় পাঁচ হাজার করে মোট ১০ হাজার লোকের বসবাস। এর মধ্যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঢালে বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। কিন্তু এ দুটি এলাকার বিষয়ে আদালতে রিট আছে। তা নিষ্পত্তি না হলে উচ্ছেদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না।
অথচ মতিঝর্ণা এলাকায় কয়েক মাস আগেও কাঁচা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে বসবাসরত আবদুল কাদের নামে একজন বললেন, ভাড়া কম বলে তারা সেখানে থাকেন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়লে পাশে নতুন ঘর করা হয়। যারা এসব ‘দেখাশোনা করে’ তাদের নতুন ঘরের জন্য টাকা দিতে হয়। কিন্তু বর্ষায় বেশি ঝুঁকি হলে প্রশাসন আবার সরিয়ে দেবে।
ঝুঁকিতে আছে ৮টি পাহাড়
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- সিডিএ ঢাকা ট্রাংক রোডের ফৌজদারহাট অংশ থেকে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণে দুই পাশে ৯০ ডিগ্রি খাড়া করে পাহাড় কাটে। সেসব পাহাড়ের মধ্যে আটটি ধসে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকি কমাতে আরও প্রায় দুই লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটতে চেয়েছিল সিডিএ।
গত বছরের অক্টোবরে এ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রস্তাব দেয় সিডিএ। এরপর অধিদপ্তর একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়। সিডিএ এর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, “প্রতিবেদন দিলে পরিবেশ অধিদপ্তরকে দেব। তারপর অনুমতি নিয়ে কাটব। এখন মোট আটটি পাহাড় ঝুঁকিতে আছে, তার মধ্যে পাঁচটির ঝুঁকি বেশি। তবে বায়েজিদ অংশের পাহাড়গুলো স্টেবল। সেগুলো কম কাটা হবে। রিটেইনিং ওয়াল দিয়ে পাহাড় রক্ষার চেষ্টা করা হবে।”
সেই অনুমতি সিডিএকে দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক নুরুল্লাহ নুরী বলেন, “কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। ৬-৭টার মত পাহাড় ঝুঁকিতে আছে। সেখানে খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ স্থাপনাও আছে। ৯ জুন এ বিষয়ে আমাদের বৈঠক আছে। এরপর উচ্ছেদ চালানো হবে।”
পাহাড়শূন্য হতে চলেছে চট্টগ্রাম নগরী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামাল হোসেন বলেন, ঝুঁকিতে থাকা বাসিন্দাদের সরাতে প্রতিবছর অভিযান হলেও তাতে পাহাড় ফেরানো যাবে না।
তিনি বলেন, “বর্ষা এলে নামকাওয়াস্তে অভিযান হয়। আর মাঝে মাঝে কিছু মাটি কাটার লোক আর যন্ত্র ধরা পড়ে। জরিমানা হয়। এসবে পাহাড় ফিরে আসবে না। বায়েজিদ লিংক রোডের পাহাড়গুলো যেভাবে আছে তাতে বর্ষায় ধসে পড়বে। তারপর মাটি সরিয়ে নেওয়া হবে। পাহাড়ই আর থাকবে না।”
তিনি বলেন, “প্রভাবশালী লোকজন ও বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মালিকানাধীন পাহাড় কাটছে। পাহাড় তো শুধু মাটি না। পাহাড়ে থাকা গাছপালা কাটা হচ্ছে। ফলে জীবজন্তু, পোকামাকড়সহ সবই ধ্বংস হচ্ছে। এভাবে একসময় চট্টগ্রাম নগরী পাহাড়শূন্য হবে, সঙ্গে প্রাকৃতির ভারসাম্যও নষ্ট হবে।”
বন ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের এই শিক্ষক মনে করেন, শহরে এখনো যে পাহাড়গুলো কাছে, তাতে টানা কয়েক বছর বনায়ন করা গেলে সেগুলো অন্তত রক্ষা পাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩২১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ