বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়িতে বম সম্প্রদায়ের যে আটজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তার পেছনে তারা ইউপিডিএফ সংস্কারপন্থীদের সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলছেন সেখানকার গ্রামবাসীরা। গত ৭ই এপ্রিল রুমা ও রোয়াংছড়ি সীমান্ত এলাকায় খামতাংপাড়ায় এই ‘হত্যাকাণ্ড’ হয়েছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। এলাকাটি রোয়াংছড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে।
বম জনগোষ্ঠির অনেকে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন, ইউপিডিএফ সংস্কারপন্থী অংশের সাথে সেনাবাহিনীর ভালো সম্পর্ক আছে।
তবে গত রবিবার (৯ই এপ্রিল) বাংলাদেশের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর থেকে গণমাধ্যমকে লিখিত এক বিবৃতির মাধ্যমে জানানো হয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডকে আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলোর নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও আধিপত্য বিস্তারের সংঘাত।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “মূলত আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলোর নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব সংঘাত ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক আত্মঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের এই আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম মূল আগ্রহ হল বিভিন্ন উৎস থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া।”
আইএসপিআর বলছে, এটা করতে গিয়ে কখনও কখনও তাদের নিজেদের অন্ত:দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে সাধারণ জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যদিও ইউপিডিএফ ডেমোক্র্যাট এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী বলে জানিয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে গত ৭ই এপ্রিল সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক উবা মং মারমা জানান, “আমরা এ সংঘর্ষে জড়িত ছিলাম না।”
কী হয়েছিল রোয়াংছড়িতে?
নিহতদের মধ্যে ছয়জন জুরভারংপাড়ার বাসিন্দা, একজন পানখিয়াং এবং একজন ফিয়াংপিডুংয়ের বাসিন্দা। কুকি-চিন নামক এই গোষ্ঠিকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন’ হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী।
রুমা উপজেলার জুরভারং পাড়ার ঘটনায় নিহত এক ব্যক্তির বড় ভাই বিবিসি বাংলাকে টেলিফোনে জানান, ৬ই এপ্রিল সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে ইউপিডিএফ সংস্কারপন্থী অংশের ২০-২৫ জনের একটি দল গ্রামে হানা দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সে ব্যক্তি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “তারা আসার আগেই গ্রামে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তারপরে যত পুরুষ মানুষকে পেয়েছে, সবাইকে আটক করে। স্কুল পড়ুয়া থেকে বৃদ্ধ – কেউ ছাড় পায়নি।”
ঘটনায় নিহত আরেক ব্যক্তি ছিলেন লালথাজার বম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী। তার এক আত্মীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গ্রামের সব পুরুষকে আটক করার পরে তাদের মাঠে শুইয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বেছে বেছে যাদের বয়স ৫০ বছরের বেশি তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে ২২ জনকে দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের খামতংপাড়ার একটি স্কুলে আটকে রাখা হয় বিকেল পর্যন্ত।
“বিকেলের দিকে ১৫ জনকে ছেড়ে দিলেও আটক থাকা বাকি সাতজনকে পরের দিন গুলি করে মেরে ফেলে। পরের দিন আমরা যখন বান্দরবান সদর হাসপাতালের মর্গে যাই মৃতদেহ আনতে, সামরিক বাহিনীর পোশাক পরা অবস্থায় দেহগুলি পাই।”
একজন মৃতের বড়ভাই বলেন, “কারও মাথার পিছনের অংশ ছিল না, হাত পা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে প্রায় সবার। তারা ওই সামরিক পোষাক পড়িয়ে এটা প্রমাণের চেষ্টা করছে যে নিহতরা কেএনএ-র সদস্য,।”
নিহতের স্বজনরা অভিযোগ করছেন, এটা পরিকল্পিত হত্যা। সাধারণ মানুষকে হত্যা করে তাদের সন্ত্রাসী বলে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর গণমাধ্যমের কাছে যে বিবৃতি পাঠিয়েছে সেখানে তারা নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত হতে পেরেছে বলেই জানাচ্ছে।
গণমাধ্যমকে দেয়া লিখিত বিবৃতিতে আইএসপিআর জানিয়েছে, সম্প্রতি যে আটজন নিহত হয়েছে তারা কেএনএ (কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি) সদস্য।
বিবৃতিতে বলা হয়, “অতি সম্প্রতি কেএনএ এবং প্রতিপক্ষ এর মধ্যে ঘটে যাওয়া বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৮ জন সদস্য কেএনএ’র সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলের সদস্য বলে তাদের পরিহিত পোশাক দেখে চিহ্নিত করা হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায় কে এন এ এর প্রতিপক্ষ হিসেবে ইউ পি ডি এফ এই সংঘর্ষের সাথে জড়িত।”
এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন অনেকে
ভারতের মিজোরামে বসবাসরত বাংলাদেশি উদ্বাস্তু নেতারা বিবিসির কলকাতা সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালীকে জানিয়েছেন, বান্দরবানে কুকি-চিন অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে গত কয়েক মাস ধরে ‘নিপীড়ন’ চলছে।
সর্বশেষ এই ‘হত্যাকাণ্ডে’র কথা পৌঁছিয়েছে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে বম সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তুদের কাছেও। তারা উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজখবর করছেন দেশের পরিস্থিতি নিয়ে।
মিজোরামে বাংলাদেশী উদ্বাস্তু সহায়ক কমিটির সাধারণ সম্পাদক বলছেন, গত বছর নভেম্বর মাস থেকে ৫৭৬ জন বম উপজাতির মানুষ ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন এবং আরও প্রায় এক হাজার মানুষ ভারত-বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন জঙ্গলে পালিয়ে রয়েছেন।
জুরভারাংপাড়ায় এখনও আতঙ্কিত মানুষ। শনিবার মৃত দেহগুলো গ্রামে ফিরিয়ে এনে গণকবর দেওয়া হয়েছে। নিহত একজনের বড়ভাই জানিয়েছেন, গ্রামের মানুষ আতঙ্কে আছে। তারা রাতে গ্রাম থেকে পালিয়ে থাকছে, আবার বেশিদূরে যেতেও পারছে না।
তবে বাংলাদেশ আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বিবৃতিতে জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা নিয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে সেগুলোর কোন ভিত্তি নেই। স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
আইএসপিআর-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ইদানিং পরিলক্ষিত হচ্ছে সহজলভ্য প্রচারণার লক্ষ্যে কেএনএ তাদের পরিচালিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সহ অন্যান্য আইন শৃংখলা বাহিনী সম্পর্কে নিয়মিত মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের হীন চেষ্টায় সচেষ্ট রয়েছে।”
এসডব্লিউ/এসএস/২২৫০
আপনার মতামত জানানঃ