বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ থাকলেও সরকার অনেক ক্ষেত্রেই তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং দেশটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার “উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা” রয়েছে বলে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার বিষয়ক এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘২০২০ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ শীর্ষক এই বার্ষিক প্রতিবেদনে মানবাধিকারের বিভিন্ন দিক নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ উঠে আসে।
বিস্তারিত এই প্রতিবেদনটিকে ৭টি মূল সেকশনে ভাগ করা হয়েছে যেখানে গুরুত্ব পেয়েছে নির্যাতন, কারাগারের বৈরী পরিস্থিতি, বেআইনিভাবে আটক, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, সহিংসতা, বেআইনিভাবে সাংবাদিক ও মানবাধিকার-কর্মীদের গ্রেফতার, সেন্সরশিপ আরোপ, সাইট ব্লকিং, শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া ও সংগঠনের অধিকার হরণ, চলাচলের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ ও সহিংসতা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি সহিংসতা ও হুমকি, সমকামীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, শ্রমিক সংগঠন ও ইউনিয়ন গঠনে কঠোরতা এবং শিশু শ্রমের মতো বিষয়গুলো।
সমালোচনার উর্ধ্বে সরকার!
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সাথে তুলনা করা হয়। যার সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন পর্যন্ত হতে পারে। অনেক সাংবাদিক সরকারের হয়রানি ও নিপীড়নের ভয়ে স্ব-প্রণোদিত হয়ে সরকারের সমালোচনা করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন।
প্রতিবেদন বলছে, আইনে ‘হেইট স্পিচ’ বা ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও একে যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। যার কারণে সরকার নিজের সুবিধা মতো একে ব্যবহার করে আসছে।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই কমপক্ষে ১৯ জন সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং অন্য নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই আইনের আওতায় মামলা করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা উল্লেখ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, মহামারি মোকাবিলা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ড বিষয়ে প্রশ্ন করায় ব্যাপকভাবে অনেকের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছে।
গত বছরের মে’র প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে অন্তত ১৯ সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং নাগরিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মানহানি, গুজব ছড়ানো ও সরকারবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার পর দেশটির প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও ক্ষমতাসীন সরকারের সহযোগী ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়, হয়রানি করে এবং ভয় দেখায়। পর্যবেক্ষণে আরও উঠে আসে, যেসব গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করেছে কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য তুলে ধরেছে তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং কয়েক মাস ধরে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য ফটোসাংবাদিক কাজল এবং আরও ৩১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। যেখানে অভিযোগ আনা হয় মাদক ও আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদনের কারণে তার মানহানি হয়েছে। এ ঘটনায় কাজলকে ২৩৭ দিন কারাভোগ করতে হয়। গত ২৫ ডিসেম্বর জামিনে ছাড়া পান কাজল।
যদিও প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যায়, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে, কিংবা জনশৃঙ্খলা, শালীনতা, নৈতিকতার বিরুদ্ধে যায় অথবা আদালত অবমাননাকারী বা অপরাধে প্ররোচণাদানকারী বলে মনে করে, তাহলে সেই মত প্রকাশকে বাংলাদেশ সরকার বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
মহামারী নিয়ন্ত্রণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন গতকাল এই রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে বলেন, কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নতুন এমন সব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে যা আগে কখনও দেখা যায়নি। ২০২০ সালের পর্যবেক্ষণে সেইসব দিকও উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, ‘মহামারি কেবল কোনো ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত দিকেই প্রভাব ফেলেনি, সেইসঙ্গে মানবাধিকার ও নিরাপদে তার মৌলিক স্বাধীনতাতেও প্রভাব ফেলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারীর সময় সরকার ২০১৮ সালে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে মহামারি মোকাবিলায় সরকারের সমালোচনাকারী ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে।
এছাড়া অন্যভাবেও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। এপ্রিলে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন।
ইন্টারনেট পরিষেবা ও পত্রিকার উপর কড়াকড়ি
এছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় সরকার ইন্টারনেট যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করা, ফিল্টার কিংবা ব্লক করার মতো পদক্ষেপ নিয়ে থাকে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গত বছর রোহিঙ্গা শিবিরে থ্রিজি এবং ফোরজি ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আল-জাজিরা, আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ রাখার বিষয়গুলোও উঠে আসে। শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার অধিকারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলেও জানানো হয়।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকার বা এর এজেন্টদের হাতে বিচার বহির্ভূত ও বেআইনি হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন ও বেআইনিভাবে আটক রাখা, দুর্নীতি, এবং মত প্রকাশে বাধা দেয়ার মতো ইস্যুগুলো।
সংবিধান অনুযায়ী, জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার দেয়া হলেও বাংলাদেশে নির্বিচারে ও বেআইনিভাবে হত্যার অসংখ্য ঘটনা রয়েছে
স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী দেশে গত বছর জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে ১৯৬টি বিচার-বহির্ভূত হত্যা হয়েছে। ২০১৯ সালেএর সংখ্যা ছিল ৩৮৮ আর ১৮ সালে ছিল ৪৬৬টি।
গত সেপ্টেম্বরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে যে, ২০১৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত শতাধিক রোহিঙ্গা বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এসব রোহিঙ্গাকে ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাননি। তিনি বলেছেন, এরা সবাই অস্ত্রধারী মাদক ব্যবসায়ী ছিল। যারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছিল।
জুলাইয়ের ৩১ তারিখে কক্সবাজারে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। যেখানে বলা হয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং এর জের ধরে পরবর্তীতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। হত্যার দায়ে ২১ পুলিশ কর্মকর্তা বহিষ্কার এবং নয় জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এখনও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম এবং অপহরণের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে। গত বছরের ১০ মার্চ বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ফটো-সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল গুম হন। মে মাসে তার খোঁজ মিললেও তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা করা হয়। মোট ২৩৭ দিন কারাগারে থেকে অবশেষে ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান তিনি।
বাংলাদেশের আইন ও সংবিধানে নির্যাতন নিষিদ্ধ হলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও মিডিয়ার মতে, নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক সাজা দিয়ে থাকে।
শ্রমিক সংগঠনে অনিয়মিত
এই প্রতিবেদনে আইনে শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার থাকলেও শ্রমিক সংগঠন হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার শর্ত কঠোর বলে উল্লেখ করা হয়। বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নথিভুক্তির শর্তের অপব্যবহার করা হয়। কারণ ছাড়াই বাতিল করা হয় নথিভুক্তির আবেদনও।
রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা ইপিজেডের প্রায় ৫ লাখ শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আইনের মাধ্যমে খর্ব করা হয়েছে। শ্রমিক কল্যাণ সংস্থাগুলো বেশিরভাগ সময়েই বেপজার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় – যার কারণে স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন সম্ভব হয় না।
সলিডারিটি সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের পর থেকে ইউনিয়ন নথিভুক্ত করা ও অনুমোদনের জন্য আবেদনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
২০১৮ সালে করা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক জরিপে দেখা যায় যে, ৯৭.৫ ভাগ গার্মেন্টস শ্রমিক কোন শ্রম ইউনিয়নের সাথে যুক্ত নন।
ওই বছরেই শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় অবশ্য জানায় যে, তৈরি পোশাক শিল্পে ৯০৯টি ট্রেড ইউনিয়ন এবং ১৬০৯টি কমিটি রয়েছে।
এছাড়া শ্রমিকদের আন্দোলন উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে ২৬ টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকল বন্ধের বিষয়টিও উঠে আসে।
এছাড়া জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যৌন শোষণের মামলা ও অভিযোগের তেমন তদন্ত না হওয়া, ভুক্তভোগীদের পর্যাপ্ত সরকারি সহযোগিতা ও নিরাপত্তা না দেয়ার মতো অভিযোগ তুলে ধরা হয়।
তৈরি পোশাক ও চিংড়ি শিল্প ছাড়া সব সেক্টরেই শিশু শ্রম রয়েছে বলে জানানো হয়। সেই সাথে মজুরি বৈষম্য, গ্রহণযোগ্য কর্ম-পরিবেশের বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ