বর্তমানে বাংলাদেশে স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সরকারি অফিস কিংবা আদালত—প্রায় প্রতিটি জায়গায় “স্যার” ও “ম্যাডাম” শব্দ দুটি অত্যন্ত প্রচলিত। শিক্ষক, আমলা, ম্যাজিস্ট্রেট, এমনকি বিচারকদের পর্যন্ত এভাবেই সম্বোধন করা হয়। তবে এই রেওয়াজ আদৌ কি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ, নাকি এটি ঔপনিবেশিক শাসনের রেখে যাওয়া মানসিক দাসত্বের চিহ্ন?
লেখক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার বই ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন-এ ব্যাখ্যা করেছেন যে, এই সম্বোধন বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত ভাষাচর্চা থেকে উদ্ভূত নয়। এটি এসেছে ব্রিটিশ শাসনের সময়কার মানসিকতা থেকে, যেখানে অধীনতা এবং আনুগত্যই ছিল শ্রদ্ধার মূল মানদণ্ড।
‘স্যার’ শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ sire থেকে, যার অর্থ প্রভু বা কর্তৃপক্ষ। ইংল্যান্ডে এই শব্দটি রাজকীয় উপাধি ‘নাইট’ পাওয়া ব্যক্তিদের নামের আগে বসত। পরবর্তীতে উপনিবেশগুলোতে এটি এমন এক শব্দে রূপ নেয় যা কর্তৃত্বের প্রতীক এবং ক্ষমতার চিহ্ন বহন করে। আর ‘ম্যাডাম’ এসেছে ফরাসি ‘মাদাম’ শব্দ থেকে, যেটি প্রথমে ইউরোপীয় নারীদের জন্য ব্যবহৃত হতো, পরবর্তীতে তা ভারতীয় উপমহাদেশে ‘মেমসাহেব’ হয়ে প্রচলিত হয়।
ভারতীয় লেখক উদয়লাল পাই তার বই Are We Still Slaves?-এ দাবি করেন, SIR শব্দের এক ব্যাখ্যা হলো— Slave I Remain এবং Servant I Remain, অর্থাৎ উপনিবেশে এ শব্দটির ব্যবহার ছিল অধীনতার এক চূড়ান্ত প্রকাশ।
১৭শ শতকে ব্রিটিশরা উপমহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করার সময় থেকেই ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ শব্দ দুটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। স্থানীয় জনগণ ব্রিটিশ অফিসারদের ‘স্যার’ এবং ইউরোপীয় নারীদের ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করতো, যা ছিল শ্রদ্ধা নয়, বরং ভয় ও কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ার প্রকাশ। এই শব্দগুলো তখন প্রতিপত্তি ও সামাজিক শ্রেণিবিভাজনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
লর্ড ম্যাকলে ১৮৩৫ সালে উপমহাদেশে এমন একটি শ্রেণি তৈরির কথা বলেন যারা রং ও জন্মে ভারতীয় হলেও চিন্তায়, ভাষায় ও বোধে হবে পুরোপুরি ব্রিটিশ। তার এই শিক্ষানীতির মধ্য দিয়েই উপনিবেশে ইংরেজি শিক্ষা এবং সঙ্গে সঙ্গে ‘স্যার-ম্যাডাম’ সংস্কৃতির প্রবর্তন ঘটে।
বাংলা ভাষায় পূর্বে শিক্ষককে ‘মাস্টারমশাই’, ‘পণ্ডিতমশাই’, কর্মকর্তাকে ‘সাহেব’, নারীদের ‘বেগম সাহেব’ বলে সম্বোধনের প্রচলন ছিল। ‘সাহেব’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘সাহাবী’ থেকে, যার অর্থ সাথী বা সঙ্গী। তবে ব্রিটিশরা এই শব্দেরও অর্থবিকৃতি ঘটিয়ে একে কর্তৃত্বের প্রতীক করে তোলে। এক সময় সাহেব শব্দটি রাজকর্মচারীদের পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেমন ‘চৌধুরী সাহেব’ বা ‘সচিব সাহেব’ হয়ে ওঠে।
আসলে ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ শব্দদ্বয়ের বাংলা সংস্কৃতিতে কোনো স্থান ছিল না। এই শব্দদ্বয় এসেছে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের প্রভাবে, এবং আজ পর্যন্ত তারা টিকে আছে বাংলাদেশে এক ধরনের মানসিক দাসত্বের পরিচয় বহন করে।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন বাতিল করে ‘জনাব’ ও ‘মহোদয়/মহোদয়া’ ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়। সেই বছরের ১১ ডিসেম্বর সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের জারি করা একটি প্রজ্ঞাপনে এই সুপারিশ করা হয়। তবে বাস্তবে এই নির্দেশনা কখনোই কার্যকর হয়নি। আজও অফিস আদালতে সাধারণ মানুষ একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা পর্যন্তকে ‘স্যার’ বলে ডাকে।
এই প্রসঙ্গে সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ২০২১ সালে বলেন, সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধনের কোনো সরকারি নীতিমালা নেই। এটি একটি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রীতি মাত্র।
তবে এই রীতি কেবল শ্রদ্ধার প্রকাশ নয়, বরং তা অনেক ক্ষেত্রে ‘পাওয়ার গেইম’ বা ‘কৌশলগত ভাষা’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কারো সঙ্গে ভালো ব্যবহার পেতে, সুবিধা আদায় করতে কিংবা আত্মরক্ষা করতে সাধারণ মানুষ এ শব্দগুলো ব্যবহার করে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ না বললে অনেক সময় শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। যদিও বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোথাও এ ধরনের বাধ্যবাধকতার উল্লেখ নেই।
আদালতেও এই চর্চা বহাল রয়েছে। নিম্ন আদালতে বিচারকদের ‘স্যার’ বা ‘ইওর অনার’, উচ্চ আদালতে ‘মাই লর্ড’ বা ‘মি লর্ড’ সম্বোধন প্রচলিত থাকলেও এগুলোর কোনোটা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক নয়। ২০১২ সালের সংশোধিত হাইকোর্ট রুলসে কেবল সম্মানসূচক সম্বোধনের কথা বলা হয়েছে, ‘স্যার’ বলা বাধ্যতামূলক নয়।
একইভাবে শেখ হাসিনার শাসনামলে তার দপ্তরের ভিতরে ‘স্যার’ সম্বোধন একটি প্রটোকল রূপে ব্যবহৃত হতো। এমনকি নারী হয়েও প্রধানমন্ত্রীকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করা হতো প্রটোকল অফিসার, সচিব ও নিরাপত্তারক্ষীদের পক্ষ থেকে। এটি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালায় ছিল না, বরং অভ্যন্তরীণ আচরণবিধির অংশ ছিল মাত্র।
সবশেষে, ২০২৫ সালের ১১ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রটোকল বাতিল করে ‘স্যার’ সম্বোধনকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ঘোষণা করেছে। এই সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
বাংলাদেশের সমাজে ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ শব্দ দুটি যে এখনো কতটা প্রভাবশালী, তার প্রমাণ প্রতিদিন হাজারোবার উচ্চারিত এই শব্দ। অথচ এটি কোনো আইন, বিধি বা নির্দেশনাজাত নয়; বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক অভ্যাস—যা কখনো বাধ্যতামূলক ছিল না, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে কার্যত বাধ্যতামূলক করে তোলা হয়েছে।
শিক্ষা ও প্রশাসনে উপনিবেশিক রীতিনীতি এখনও বহাল রয়েছে। আর ‘স্যার-ম্যাডাম’ তার সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীক। সময় এসেছে আমাদের সমাজকে প্রশ্ন করার—এই শব্দের পেছনে লুকিয়ে থাকা ক্ষমতা, শ্রেণিবিভাজন ও মানসিক পরাধীনতা আমরা আর কতদিন টেনে নেব?
আপনার মতামত জানানঃ