ইসরাইলের অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের হাতে একজন মার্কিন নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনায় নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। ফিলিস্তিনি-মার্কিন নাগরিক সাইফুল্লাহ মুসালেত, যিনি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ফিলিস্তিনে গিয়েছিলেন, শুক্রবার পশ্চিম তীরের সিনজিল শহরে নির্মমভাবে নিহত হন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, একদল সশস্ত্র ইসরাইলি বসতিস্থাপনকারী তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। এই হামলায় আরও কয়েকজন ফিলিস্তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন।
ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেওয়া হয়। তারা জানান, একজন মার্কিন নাগরিকের মৃত্যুর বিষয়ে তারা অবগত, তবে নিহতের পরিবারের গোপনীয়তার কারণে তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলবেন না। এই নীরবতা নিয়েই তৈরি হয়েছে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন। মানবাধিকারকর্মীদের ভাষ্যমতে, এটি একমাত্রিক কোনো ঘটনা নয়; বরং পশ্চিম তীরে বসতিস্থাপনকারীদের সহিংসতা বহুদিন ধরেই চলমান। তারা ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে, রাস্তা অবরোধ করছে, যানবাহন ও সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করছে—এমনকি ইসরাইলি সেনাবাহিনী অনেক সময় এসব সন্ত্রাসীদের পক্ষেই কাজ করছে। প্রতিরোধ করলেই ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি বর্ষণ করা হয়।
জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এই বসতি স্থাপনকে স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করেছে। তাদের মতে, এটি একটি পরিকল্পিত বাস্তুচ্যুতকরণ প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের নিজভূমি থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ ২০২৩ সালে গাজার যুদ্ধ শুরুর পর ইসরাইলি বসতিস্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরই পূর্বতন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, যা বাইডেনের সময় আরোপিত হয়েছিল।
সাইফুল্লাহ মুসালেতের মতো মার্কিন নাগরিকদের এভাবে হত্যার ঘটনা কিন্তু নতুন নয়। ২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনীর হাতে ৯ জন মার্কিন নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে আল জাজিরার সাংবাদিক শিরীন আবু আকলেহর মৃত্যু ছিল সবচেয়ে আলোচিত। কিন্তু এসব ঘটনায় আজ পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ বা বিচার হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের মৃত্যুর বিচার প্রক্রিয়ায় নিষ্ক্রিয়তার কারণে দিন দিন বেড়েই চলেছে ইসরাইলি বেপরোয়া আচরণ। মার্কিন আইনজীবীদের অভিযোগ, মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিপুল অর্থে ইসরাইলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিলেও, সেই সাহায্যের বিনিময়ে তারা কোনো জবাবদিহিতা আদায় করতে পারছে না।
এই ঘটনার পর শুক্রবার কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) কড়া ভাষায় ওয়াশিংটনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যাতে তারা মুসালেত হত্যার পূর্ণ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করে। সিএআইআরের উপপরিচালক এডওয়ার্ড আহমেদ মিচেল বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার একের পর এক মার্কিন নাগরিক হত্যার কোনো সঠিক বিচার না করায়, ইসরাইল এই ধরণের অপরাধ ঘটাতে আরও উৎসাহ পাচ্ছে। তিনি ব্যঙ্গ করে বলেন, যখন ইসরাইল প্রকাশ্যে মার্কিন নাগরিকদের হত্যা করছে, তখন ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান বাস্তবে ‘ইসরাইল ফার্স্ট’ নীতিতেই পরিণত হয়েছে।
এই মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক উস্কে দিচ্ছে। একদিকে মার্কিন প্রশাসন ইসরাইলের নিরঙ্কুশ মিত্র হিসেবে নিজেদের প্রমাণ দিতে চায়, অন্যদিকে নিজেদের নাগরিকদের মৃত্যুতেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে মৌনতা পালন করে।
ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সহিংসতা এখন শুধু একটি আঞ্চলিক সমস্যা নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেই চ্যালেঞ্জে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইলের প্রতি অতিরিক্ত পক্ষপাত দেখিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে তাদের নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছে।
সাইফুল্লাহ মুসালেতের মৃত্যু শুধু একটি মর্মান্তিক ঘটনা নয়—এটি হলো একটি দীর্ঘদিনের দখলদারির নৃশংস রূপের প্রতীক। একজন মার্কিন নাগরিক, যিনি নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে এসে প্রাণ হারালেন, তার হত্যাকারীরা যদি শাস্তি না পায়, তাহলে প্রশ্ন থাকবে—ইসরাইলের বিরুদ্ধে কে কথা বলবে? কারা বিচার নিশ্চিত করবে? এবং কতজন মার্কিন নাগরিককে আরও মরতে হবে এই নীরব সমর্থনের নীতির বলি হয়ে?
আপনার মতামত জানানঃ