ইরানের রাজধানী তেহরানের মিলিটারি কমান্ড সেন্টারের ভেতরে একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের এক সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং গোটা বিশ্ব রাজনীতির দিকে নতুন করে নজর কাড়ছে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে ইসরায়েল রয়েছে তা গোপন কিছু নয়। আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা বিশ্লেষকরা এটিকে একটি “সুনির্দিষ্ট বার্তা” হিসেবে বিবেচনা করছেন, যার অর্থ একটাই—ইরান যেন জানে, তার ভেতরে ঢুকে লক্ষ্যবস্তু গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ইসরায়েল রাখে এবং প্রয়োজনে সেটা করেও। কিন্তু এই হামলা একমাত্র সামরিক পরিণতিই নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে খোঁচা দেওয়া হয়েছে ইরানের সম্মান, আত্মমর্যাদা এবং তার আঞ্চলিক আধিপত্যের দাবিকে।
এই ঘটনাটিকে কেবল ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা ভুল হবে। এটা মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। কারণ এই ঘটনার মাধ্যমে ইরানকে প্রমাণ করতে হচ্ছে—সে কেবল আঘাত নিতে জানে না, আঘাতের জবাব দিতেও পারে। অন্যদিকে, ইসরায়েল এই বার্তা দিতে চাইছে যে, আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ কিংবা আমেরিকার কোনো হুশিয়ারি তাদের পথে বাধা নয়। এখানেই এই ঘটনার ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর।
ইরান ও ইসরায়েলের এই সংঘাত যেন মধ্যপ্রাচ্যের আগুনে আরও জ্বালানির মতো কাজ করছে। সামরিক হত্যাকাণ্ডের পেছনে শুধু শত্রুতা নয়, এক ধরনের রাজনৈতিক কূটনীতির খেলা চলছে যা ভাবিয়ে তোলে—এই উত্তেজনা কবে থেকে আর কোথায় গিয়ে থামবে, তা প্রায় অজানা। ইসরায়েল যখন এককভাবে বড় ধরনের হামলা চালাচ্ছে, তখন তারা শুধু ইরানের সেনাপ্রধানকে লক্ষ্য করেনি, বরং ইরানকে এই সংকেত দিয়েছে যে তারা যে কোনো সময় যেকোনো জায়গায় আঘাত করতে পারে, এমনকি তেহরানের অন্তরালে ঢুকে গোপন অভিযান চালানো তাদের পক্ষে কঠিন নয়।
এই ঘটনার ফলে ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশও কেঁপে উঠেছে। দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সামরিক শিবির পর্যন্ত সবাই এখন “সন্ত্রাসী ইসরায়েল” এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। এতে করে ইরানের সরকার একদিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাপ সামলাতে বাধ্য, অন্যদিকে বহিরঙ্গন সামরিক উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার ভূমিকাও খুবই স্পর্শকাতর। ট্রাম্পের সময়কার পুরনো সমঝোতা উপেক্ষা করে নেতানিয়াহু নিজের উদ্যোগ নিয়েছেন, যা আমেরিকার কূটনৈতিক অবস্থা আরও জটিল করে তুলেছে।
এই হত্যাকাণ্ডের পর ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেই সরাসরি বক্তব্য দিয়েছেন যে, শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, এই হামলার জবাব কেবল ইসরায়েল পাবে না, বরং যারা এটি অনুমোদন দিয়েছে, তারাও দায় এড়াতে পারবে না। এই বক্তব্যটি যথেষ্ট পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে, যদিও এবার একটি বড় পার্থক্য তৈরি হয়েছে—এই হামলার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ইসরায়েল আমেরিকাকে পাশে রাখেনি। ট্রাম্প যুগে মধ্যপ্রাচ্যে যেসব গোপন সমঝোতা হয়েছিল, সেগুলোকে উপেক্ষা করে ইসরায়েল নিজে থেকেই একক সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে আমেরিকাকে একপ্রকার অসম্মানও করেছে।
নেতানিয়াহুর এই আচরণ শুধু ইরানের প্রতি হুমকি নয়, বরং আমেরিকান ডিপ্লোমেসির ওপরও একধরনের আস্থা সংকটের সৃষ্টি করেছে। বহু বছর ধরে আমেরিকা ইসরায়েলের নিরাপত্তার গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করলেও ইসরায়েল এখন স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিচ্ছে, তারা নিজস্ব নিরাপত্তার বিষয়ে কাউকে বিশ্বাস করে না—ইভেন হোয়াইট হাউসকেও নয়। এ থেকেই বোঝা যায়, বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন চিত্র তৈরি হচ্ছে যেখানে মিত্রতা আর পুরনো নীতিগুলো সব সময় কার্যকর থাকছে না।
এখন প্রশ্ন উঠছে, ইরান কী ধরনের প্রতিশোধ নিতে পারে। প্রথম সম্ভাব্য পথ হলো সরাসরি সামরিক জবাব। ইরান চাইলে ইসরায়েলের কোনো সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তাদের সীমান্ত অঞ্চলে আঘাত হানতে পারে। কিন্তু এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ সরাসরি আঘাতের মানে হবে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হওয়া, যেখানে ইসরায়েল একা থাকবে না—আমেরিকা, ব্রিটেন ও ন্যাটোও সরাসরি জড়াবে। ফলে ইরান সরাসরি যুদ্ধের দিকে যেতে চাইবে না, তবে তার প্রতিশোধ হতে পারে বহুস্তরীয়, ছদ্মবেশী ও দীর্ঘমেয়াদি।
এই পরিস্থিতিতে ইরানের আরেকটি সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে তার প্রো-ইরানিয়ান মিলিশিয়া বাহিনীগুলোকে কাজে লাগানো। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাকের কাতায়েব হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার ফাতেমিয়ুন ব্রিগেড কিংবা ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা—সবাই প্রস্তুত আছে এবং এই বাহিনীগুলো বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়েছে। ইরান চাইলে তাদের মাধ্যমে সীমিত বা মাঝারি মাত্রার প্রতিশোধ নিতে পারে, যেমন সীমান্তে হামলা, ড্রোন আক্রমণ, কিংবা ইসরায়েলের কিছু বাণিজ্যিক স্থাপনায় বিস্ফোরণ। এতে করে ইরান সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার দায় এড়াতে পারবে, আবার সম্মান রক্ষাও হবে।
আরও একটি অত্যন্ত সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে সাইবার প্রতিশোধ। ইরান দীর্ঘদিন ধরেই সাইবার যুদ্ধক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, তারা ইসরায়েলি ব্যাংক, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ও ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেমে একাধিকবার সাইবার হামলা চালিয়েছে। বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে এমন হামলা ইসরায়েলের অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে এবং জনমনে ভীতি ছড়াতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি গুরুত্বপূর্ণ কোনো অবকাঠামোকে লক্ষ করে হয়।
কিন্তু এই উত্তেজনার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে? ট্রাম্প প্রশাসন এই মুহূর্তে নির্বাচনী সংকটে রয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ তাদের পক্ষে নেওয়া খুব কঠিন। তার ওপর আমেরিকার জনগণ এখন যুদ্ধক্লান্ত, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের পর তাদের আর যুদ্ধ চায় না। তবে আবারও, যদি ইরান এমন কিছু করে যাতে ইসরায়েলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য চুপ থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে তারা হয়তো সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে কৌশলগত অস্ত্র সহায়তা, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, কিংবা সাইবার প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে জবাব দিতে পারে।
রাশিয়া ও চীন এই পরিস্থিতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে, তবে তা সরাসরি সামরিক নয়। রাশিয়া, বিশেষ করে সিরিয়ায় ইরানের মিত্র, এবং চীন ইরানের প্রধান তেল ক্রেতা ও অর্থনৈতিক অংশীদার। এই দুই দেশ চাইবে না মধ্যপ্রাচ্য আবার একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক, কারণ তা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কিন্তু তারা কূটনৈতিকভাবে ইরানের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে আমেরিকা ও ইসরায়েলকে চাপে ফেলতে পারে।
অন্যদিকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান এই পরিস্থিতিতে খুবই সংবেদনশীল। যদিও তারা ইরানের বিরোধী শিবিরে, কিন্তু তারা কখনোই চায় না ইরান পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাক। কারণ তাতে পুরো অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে এবং তাদের রাজতন্ত্র হুমকিতে পড়বে। ফলে এই আরব দেশগুলো চাইবে, ইরান যেন এক ধরণের সম্মানজনক প্রতিশোধ নিয়ে থেমে যায়, যাতে কোনো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ না হয়। তুরস্কও এই সুযোগে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে নিজের কূটনৈতিক অবস্থান জোরদার করতে পারে।
এই পরিস্থিতির আরেকটি জটিলতা হলো ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ। ইরান নিজেকে সব সময় ফিলিস্তিনের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছে, এবং ইসরায়েলকে দখলদার রাষ্ট্র বলেছে। এই সাম্প্রতিক ঘটনার পর ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠনগুলো—বিশেষ করে গাজা থেকে হামাস—ইরানের পক্ষ নিতে পারে এবং সীমান্ত উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। এতে করে ইসরায়েল দুই ফ্রন্টে চাপে পড়বে—একদিকে ইরান, অন্যদিকে গাজা। যদিও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উন্নত, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ চালানো তাদের জন্যও চাপের বিষয়।
সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিকে একটি “ক্লাসিক প্রি-ওয়ার সিনারিও” বলা যেতে পারে। সবাই যুদ্ধ চায় না, কিন্তু সবাই প্রতিশোধ চাইছে। কেউ কেউ কূটনৈতিক পথ বেছে নিচ্ছে, আবার কেউ কেউ মাঠে শক্তি প্রদর্শন করছে। এমন এক সময় চলছে যেখানে কোনো একটি ভুল পদক্ষেপ গোটা অঞ্চলকে বিস্ফোরণে ঠেলে দিতে পারে। ইতিহাস বলে, যখন প্রতিশোধ আর সম্মান একসঙ্গে কাজ করে, তখন রাজনীতির ভাষা অকার্যকর হয়ে পড়ে, এবং যুদ্ধই হয়ে ওঠে একমাত্র উত্তরের মাধ্যম।
এই ঘূর্ণাবর্তের মাঝে কেবল ইরান নয়, ইসরায়েল ও আমেরিকার ভবিষ্যত কৌশলও পরীক্ষার মুখে। এই তিন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি, বিশ্ববাজারের স্থিতিশীলতা, এমনকি আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভবিষ্যৎ ভারসাম্য। এই সময়টা, সত্যি বলতে, এক চরম উত্তেজনার সময়—যেখানে প্রত্যেকটি দিন একেকটি সম্ভাব্য বিস্ফোরণকে গর্ভে ধারণ করে আছে।
আপনার মতামত জানানঃ