২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েলের অব্যাহত গণহত্যার বর্বরতা আন্তর্জাতিক সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিলেও, ওয়াশিংটনের ভূমিকা এই পুরো সংঘাতের নেপথ্যে এক অপ্রকাশ্য অথচ গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করে। দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের একমাত্র ও অটল পৃষ্ঠপোষক, কিন্তু ‘প্রজেক্ট এস্থার’-এর মতো রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রমাণ করছে যে ওয়াশিংটন কেবল একটি পক্ষে সমর্থন দেয়নি—তারা সক্রিয়ভাবে ফিলিস্তিন সংহতির আন্দোলনকে নির্মূল করার প্রকল্প চালাচ্ছে।
‘প্রজেক্ট এস্থার’ নামটি বাইবেলের একটি চরিত্রের অনুসরণে দেওয়া হলেও এর উদ্দেশ্য যেন ঠিক বিপরীত। বাইবেল অনুসারে, এস্থার ছিলেন এক ইহুদি রাণী যিনি নিজ জাতিকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান ‘প্রজেক্ট এস্থার’ নামক পরিকল্পনা মূলত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলার অধিকার হরণ করতে চায়—যেটি যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক বাকস্বাধীনতার নীতির সরাসরি লঙ্ঘন। পরিকল্পনাটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী থিঙ্কট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, যা বহুদিন ধরে রিপাবলিকানদের নীতিগত কৌশলের অন্যতম মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
এই ২৪ মাসের কৌশলগত রূপরেখা—প্রজেক্ট এস্থার—মূলত ‘হামাস সাপোর্ট নেটওয়ার্ক’ নামের একটি কাল্পনিক শত্রু গড়ে তোলে। এই তথাকথিত নেটওয়ার্কে এমনকি মুসলিম, আরব, প্রগতিশীল ইহুদি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গোষ্ঠীগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই নেটওয়ার্কের কোনো প্রমাণ নেই। বরং এর উদ্দেশ্য হলো একটি কল্পিত নিরাপত্তা হুমকির দোহাই দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরে ও বাইরে ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকা সকল কণ্ঠস্বরকে দমন করা।
এই প্রকল্পের মধ্যে ১৯টি নির্দিষ্ট ‘কাঙ্ক্ষিত ফলাফল’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন—ফিলিস্তিনপন্থী বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রবেশে বাধা, ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করা, সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক অভিযোগ আনা, সামাজিক মাধ্যমে সেন্সর করা, এমনকি ফিলিস্তিনপন্থী ছাত্র সংগঠনের তথ্য প্রকাশ করে তাদের হয়রানির পথ প্রশস্ত করা। এর বাস্তব উদাহরণ পাওয়া গেছে ক্যানারি মিশন নামক ওয়েবসাইটে, যেটি ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রকল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য কেবল ইসরায়েলের সমর্থন নয়, বরং ফিলিস্তিন সংহতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জন্ম নেওয়া নতুন রাজনৈতিক চেতনার রাশ টেনে ধরা। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫০-এর নিচে বয়সী ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ৭১ শতাংশ ইসরায়েলের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের বহু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে—যেখানে ফিলিস্তিন সংহতির দাবিতে বিক্ষোভ, আন্দোলন ও সচেতনতামূলক প্রচারণা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই কলেজ ক্যাম্পাসগুলো এখন এই প্রকল্পের মূল ‘যুদ্ধক্ষেত্র’।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো—এই ধরনের পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সরাসরি অংশ নিচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে ইতোমধ্যে বহু শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে। ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া মিডল ইস্ট স্টাডিজ বিভাগগুলোর পাঠ্যক্রমকেও রাজনৈতিক চাপে পর্যালোচনার আওতায় আনা হচ্ছে। যেমন—কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে ট্রাম্প সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে।
এইসব কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভিক্টোরিয়া কোয়েটস, যিনি ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রজেক্ট এস্থার শুধুমাত্র একটি নীতিগত রূপরেখা নয়, বরং একটি কৌশলগত আক্রমণ—যার লক্ষ্য হচ্ছে ‘অপর পক্ষের কণ্ঠস্বরকে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেওয়া’। এতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অভিবাসন নীতি, শিক্ষা নীতি এবং মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত।
এই পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে এক সুস্পষ্ট মার্কিন স্বার্থ—মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রাধান্য রক্ষা করা এবং যেকোনো সমালোচনামূলক শক্তিকে আগেভাগেই থামিয়ে দেওয়া। ইতিহাস বলছে, যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ইসরায়েলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে এসেছে। মার্কিন কংগ্রেসে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন একপ্রকার বাইবেলীয় দায়িত্বের মতো করে দেখা হয়। এই সমর্থনের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার কৌশলগত আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছে।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই সমর্থন কেবল ‘নৈতিক পক্ষপাতিত্ব’ নয়; বরং এটি একটি সংগঠিত দমনমূলক ব্যবস্থা—যেটির ভুক্তভোগী হচ্ছে ফিলিস্তিনপন্থী সংগঠন, শিক্ষার্থী, মানবাধিকারকর্মী এবং এমনকি ইহুদি বংশোদ্ভূত সমালোচকরাও। এই দমনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে এক নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠছে—যা স্পষ্টভাবে মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এই চেতনাকে দমন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা।
‘জুয়িশ ভয়েস ফর পিস’ (জেভিপি) নামক প্রগতিশীল ইহুদি সংগঠনের রাজনৈতিক পরিচালক বেথ মিলার বলেন, ‘‘এই বর্বর হুমকি আমাদেরকে চুপ করায়নি, বরং আমাদেরকে আরও দৃঢ় করেছে।’’
এই বক্তব্য প্রমাণ করে, প্রজেক্ট এস্থারের মতো পরিকল্পনা বাস্তবে উল্টো জনসচেতনতা ও প্রতিবাদের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে। যদিও প্রশাসন আইন, অভিবাসন ও প্রযুক্তির মাধ্যমে এই আন্দোলনগুলোকে দমন করার চেষ্টা করছে, তবু তা সত্ত্বেও ফিলিস্তিন সংহতির বার্তা যুক্তরাষ্ট্রের যুব সমাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করছে।
অতএব, ‘প্রজেক্ট এস্থার’ নামক কৌশলগত নীলনকশা একটি বৃহত্তর মার্কিন ষড়যন্ত্রের অংশ—যার মূল উদ্দেশ্য শুধু মধ্যপ্রাচ্যে একটি পুতুল রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান নেওয়া নয়, বরং নিজ দেশের ভেতরে গড়ে ওঠা মানবতা ও ন্যায়বিচারের আওয়াজকে নির্মূল করা। এই ষড়যন্ত্র কেবল ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে নয়, এটি আমেরিকান গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধেও এক বড় হুমকি।
বিশ্বের সামনে এখন এই প্রশ্ন—যে রাষ্ট্র সবসময় বাকস্বাধীনতার কথা বলে, সেই রাষ্ট্রই যদি মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার দমন করতে নীতিগত পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তবে আসলে কোন নৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র?
গাজায় চলমান গণহত্যার নেপথ্যে তাই শুধু ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন নয়, বরং ওয়াশিংটনের নীরব বা স্পষ্ট অনুমোদনও রয়েছে। এই অনুমোদন কেবল নীতিগত নয়, তা কৌশলগতভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে প্রজেক্ট এস্থারের মতো পরিকল্পনার মাধ্যমে—যার চূড়ান্ত লক্ষ্য ফিলিস্তিনপন্থী কণ্ঠস্বরকে দমন করে ইসরায়েলের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখা।
আপনার মতামত জানানঃ