ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় এক যুবককে পাথর ছুড়ে প্রকাশ্যে হত্যার একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। প্রথমদিকে ঘটনাটি শুধুই একটি বর্বর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও পরে এতে বিএনপির সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন নেতা-কর্মীর সম্পৃক্ততা উঠে আসায় তা এক ভয়াবহ রাজনৈতিক বিতর্কের রূপ নেয়। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি সামনে এসেছে, তা হলো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভূমিকা ও দায় নিয়ে দেশজুড়ে ওঠা প্রশ্নের ঝড়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন বিএনপি প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে, অন্যদিকে তাদের অতীত মিত্র জামায়াতে ইসলামী ও নবগঠিত রাজনৈতিক শক্তি এনসিপির দিক থেকেও ভর্ৎসনা এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এটি নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বিএনপিকে কোণঠাসা করে রাখার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিএনপির প্রতি এমন ক্ষোভ বা অভিযোগ নতুন কিছু নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল— চাঁদাবাজি, জায়গা দখল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি। যদিও দলটি এসব ঘটনায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে হাজার হাজার কর্মীকে বহিষ্কার করেছে, কিন্তু জনমনে তাতে আস্থা তৈরি হয়নি। মিটফোর্ডে ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকাণ্ড যেন এসব অভিযোগকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও এবং এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ও জনতার বিক্ষোভ মিছিল স্পষ্ট করে যে, জনগণের একটি বড় অংশ এই ঘটনায় শুধু সাধারণ অপরাধের চিত্র দেখছে না, বরং রাজনৈতিক অনৈতিকতার প্রতীক হিসেবেই এটিকে গ্রহণ করছে।
এই পরিস্থিতিকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান। দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে অবস্থান করে দল পরিচালনার অভিযোগ বহুবার উঠেছে তার বিরুদ্ধে। সমালোচকদের মতে, দল যখন মাঠে নানা সংকটে, তখন তারেক রহমানের দূরদেশ থেকে ভার্চুয়াল নিয়ন্ত্রণ দল পরিচালনায় ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার জীবনযাপন, আয়-ব্যয়ের উৎস এবং রাজনৈতিক জবাবদিহিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ‘চাঁদা তোলে পল্টনে, ভাগ যায় লন্ডনে’, ‘ঢাকা না লন্ডন, ঢাকা ঢাকা’— এমন স্লোগান সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া স্পষ্ট করে দেয় যে, তারেক রহমানের ভূমিকা নিয়ে বিরক্তি শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নয়, বরং দলীয় কর্মীদের একটি অংশের মধ্যেও তা গভীরভাবে বিরাজ করছে।
বিএনপি নেতারা অবশ্য পুরো ঘটনাটিকে পরিকল্পিত চরিত্রহনন প্রচারণা হিসেবে বর্ণনা করছেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, এ ঘটনার পেছনে রয়েছে একটি চিহ্নিত মহল, যারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে বিএনপি ও তার শীর্ষ নেতৃত্বকে হেয় করার অপচেষ্টা করছে। এই ‘সাইবার অ্যাটাক’ ও প্রচার-প্রতিপ্রচারের মধ্য দিয়ে বিএনপিকে কোণঠাসা করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলছে— এমন অভিযোগ করেছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে এসব অভিযোগ জনমতকে কতটা প্রভাবিত করতে পারছে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের দ্বিমত রয়েছে।
রাজনীতিতে সবচেয়ে চমকপ্রদ যে পরিবর্তনটি দেখা যাচ্ছে, তা হলো জামায়াতে ইসলামীর মতো একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র দলের অবস্থান। বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তুলে জামায়াতের নেতারা সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সরাসরি বক্তব্য দিচ্ছেন। যদিও তারা কোনো ‘অশ্লীল’ শ্লোগানের দায় নিচ্ছে না, তবে ‘সারাদেশে মানুষ এক গোষ্ঠীর তৎপরতায় আতঙ্কিত’— এমন মন্তব্য করে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এনসিপিও সরাসরি তারেক রহমানকে দায়ী করে বলেছে, দল পরিচালনার সব ক্রেডিট যদি এককভাবে তারেক নেন, তবে ব্যর্থতার দায়ও তাকেই নিতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেখানে নেতৃত্বকে ‘কাল্ট ফিগার’ হিসেবে তুলে ধরা হয়, সেখানে সমালোচনার ঝড় একপর্যায়ে সেই কেন্দ্রীয় চরিত্রকে নিয়েই ওঠে— এনসিপির এমন মন্তব্যের মধ্যে দেশের রাজনীতির একটি বড় সংকেত যেন প্রতিফলিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, এই সংঘাত ও প্রচার যুদ্ধ কেবল দলগত বা আদর্শগত বিরোধের ফল নয়। বরং এর পেছনে রয়েছে বৃহত্তর রাজনৈতিক গেমপ্ল্যান। কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, মিটফোর্ডের মতো ঘটনা এবং তা কেন্দ্র করে দলগুলোর মুখোমুখি অবস্থান তৈরি করে একটি তৃতীয় পক্ষ রাজনৈতিকভাবে ফায়দা লুটছে কি না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ‘স্টেইজড কনফ্লিক্ট’-এর নজির বহুবার দেখা গেছে। যেখান থেকে সুবিধা পায় কোনো শক্তি, যাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আসার সুযোগ কম। বিশিষ্ট বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ এবং লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ এমন সম্ভাবনার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তাদের মতে, এমন পরিস্থিতি কেবল রাজনৈতিক অঙ্গনে দূরত্ব বাড়ায় না, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ঝুঁকির মুখেও ফেলে।
এই পরিস্থিতি সামনে এনেছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— বিএনপি কি আদৌ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে? হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করার পরও বারবার দলের অভ্যন্তর থেকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও সহিংসতার অভিযোগ ওঠা দলটির নৈতিক ও সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ করছে। তার ওপর, বিদেশে অবস্থানরত শীর্ষ নেতার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল দলটি বর্তমানে কার্যত ‘ডায়াসপোরা লিডারশিপ’ নামক এক বিতর্কিত মডেলের অধীনে চলছে। এ ধরনের নেতৃত্বে স্থানীয় কর্মীদের মনোভাব, তৃণমূল বাস্তবতা এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলার সঠিক সমন্বয় সম্ভব কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অন্যদিকে, তারেক রহমানের সঙ্গে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের লন্ডন বৈঠক নিয়েও নতুন করে আলোচনার জন্ম নিয়েছে। সরকারবিরোধী নানা আন্তর্জাতিক কূটনীতির সঙ্গে জড়িত দুই ব্যক্তির বৈঠককে কেউ কেউ ‘বিকল্প পরিকল্পনার সূচনা’ বলেও দেখছেন। তবে এই মুহূর্তে দলের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং রাজপথে জনভিত্তি ফিরে পাওয়াই বিএনপির জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলটির সামনে এখন দুটি বড় চ্যালেঞ্জ— একদিকে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সমালোচনার ঝড় সামাল দেয়া, অন্যদিকে সরকার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে টেকসই রাজনীতির কৌশল তৈরি করা।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপির করণীয় কী? তাদের উচিত হতে পারে সহিংসতা বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বাস্তবায়ন এবং তারেক রহমানের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে একটি বিকেন্দ্রীকৃত ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব মডেল প্রতিষ্ঠা করা। অন্যথায়, এমন বারবার বিতর্কিত ঘটনার পর জনমনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরো কমে যাবে। মিত্রদের সমর্থন হারানোর পাশাপাশি, ভবিষ্যতের যে কোনো নির্বাচন বা আন্দোলনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আস্থাও হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।
মোটের ওপর, মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে, বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামাজিক মাধ্যম, গণসচেতনতা এবং তরুণদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি কার্যকর হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন বুঝতে হবে, কোনো নেতাই আর প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়, এবং কোনো অপরাধ বা অপকর্ম জনসাধারণের চোখ এড়িয়ে যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি এই সংকেত বুঝে নিজেদের পুনর্গঠন করতে পারবে, নাকি আবারও বহির্বিশ্বের হাত ধরে অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে নিজেদের আরও দুর্বল করবে?
আপনার মতামত জানানঃ