ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস বহু পুরনো এবং রক্তাক্ত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পালটে গেছে এর চরিত্র, কৌশল ও প্রতীক। আর সাম্প্রতিক সময়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক আবদুল কাদেরের একটি ফেসবুক পোস্ট যেন নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে ফিরিয়ে এনেছে ছাত্ররাজনীতির সেই ছায়াচিত্র, যেখানে দলীয় পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিপরীত আদর্শের মুখোশধারীরা পরিণত হয়েছে ভয়ংকর নিপীড়কে। কাদেরের ভাষায়, ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা ছাত্রলীগের ছদ্মবেশে দীর্ঘদিন ধরে সহিংস রাজনীতির অংশ হয়েছেন—কখনো নিপীড়ক, কখনো কৌশলী তদবিরকারী হিসেবে।
আবদুল কাদের তাঁর পোস্টে অভিযোগ করেন, হলে থাকার কারণে অনেক ছাত্রশিবিরকর্মী আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগতে থাকেন। নিজেদেরকে ছাত্রলীগের ‘আসল’ কর্মী হিসেবে প্রমাণ করতে গিয়ে তারা হয়ে উঠেন অতি উৎসাহী, হয়ে ওঠেন আরও সহিংস। যেমন বিজয় একাত্তর হলের শাহরিয়াদকে রাতভর পেটানো ঘটনায় নেতৃত্ব দেন মাজেদুর রহমান, যিনি ছাত্রশিবির করতেন বলে কাদেরের দাবি। এমনকি ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার দপ্তর সম্পাদক মুসাদ্দিক বিল্লাহ কিংবা জসীমউদ্দীন হলের কুখ্যাত আফজালুন নাঈমও কাদেরের ভাষায় ছিলেন শিবিরের অতীত সংশ্লিষ্টতা থাকা ‘ছদ্মলীগার’।
এখানেই শেষ নয়। কাদেরের পোস্টে উঠে আসে হাসান সাঈদীর মতো একাধিক নাম, যাদের অতীতে শিবিরের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে, যারা পরে ছাত্রলীগের পরিচয়ে ক্যাম্পাসে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস চালিয়েছে। হাসান সাঈদী নামটি উল্লেখযোগ্য কারণ তিনি পরবর্তীতে নিজের নাম পরিবর্তন করে ছাত্রলীগের পদ বাগিয়ে নেন এবং এক পর্যায়ে ব্যবসায়ী অপহরণ ও মারধরের ঘটনায় গ্রেপ্তার হন। এত কিছুর পরও, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক ‘তদবির’ তাকে জামিনে বের করে আনে এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়—যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কাদের নিজেই।
এই ঘটনায় সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হলো, ছাত্ররাজনীতির ভেতরে এখন এমন একটি স্তর গড়ে উঠেছে যারা না ছাত্রলীগ, না শিবির—তারা হচ্ছে সেই হাইব্রিড শ্রেণি যারা ক্ষমতাসীন সংগঠনের ভেতরে ঢুকে পড়েছে নিজের সুবিধার জন্য। তারা নিপীড়ন করে, গেস্টরুমে মারধর করে, আর পরে দলীয় পরিচয় বদলে আবারও আত্মপ্রকাশ করে। কাদেরের অভিযোগ অনুযায়ী, এসব গুপ্ত শিবির সদস্যরা ছাত্রলীগের হাই-প্রোফাইল ক্যান্ডিডেটদের পাশে থাকেন, বক্তৃতা লিখে দেন, কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করেন।
সবচেয়ে ভয়ংকর চিত্র উঠে আসে যখন দেখা যায় এই গুপ্ত শিবিরের লোকজন ব্যাচ প্রতিনিধি নির্বাচনের মতো ছোটখাটো পদেও প্রভাব বিস্তার করছে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে অনলাইন ভোটিং করে নিজেরাই নিজেদের লোককে ব্যাচ প্রতিনিধি বানিয়েছে, যারা পরে হল প্রশাসনের ছায়া হয়ে উঠেছে। কাদেরের মতে, এরা আবারই ছাত্রলীগের নামে গঠিত বিভিন্ন কমিটির তালিকা তৈরি করেছে, যাতে তাদের ‘সাথি ভাইদের’ নাম বাদ রাখা যায়।
এখানে প্রশ্ন আসে, ছাত্রলীগের এই কাঠামোর ভেতরে এতদিন কীভাবে শিবিরের লোকজন এমন সফলভাবে ঢুকে যেতে পারল? আবদুল কাদেরের বক্তব্য অনুসারে, অনেক সময় ছাত্রলীগের নেতারাই হয়ত এসব লোকদের চিনতেন, কিন্তু ক্ষমতা ও সুবিধার জন্য তাঁদের ব্যবহারে কোনো আপত্তি ছিল না। ফলে, যারা পদ–পদবী চায়, তারাই হয় সবচাইতে ভয়ংকর। কারণ তারা নিজেদের অতীত ঢাকতে আরও বেশি নিপীড়ক হয়ে ওঠে।
কাদেরের ফেসবুক পোস্টের আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তিনি উল্লেখ করেছেন শিবিরের তৎকালীন ঢাবি শাখার সভাপতি আবু সাদিক কায়েমের একাধিক তদবিরের প্রসঙ্গ। যেমন, মামলার তালিকা থেকে নাম কেটে দেওয়ার জন্য সরাসরি তদবির, কিংবা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা। সাদিক কায়েম এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও, কাদের তাঁর পোস্টে একাধিক ঘটনার সময়কাল, নাম, ফেসবুক আইডির পরিবর্তন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ভূমিকার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন—যা একে নিছক গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন।
প্রকৃতপক্ষে, এই পোস্ট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে, ক্যাম্পাস রাজনীতির শেকড়ে আজ এমন বহু ছায়া–চরিত্র ঢুকে পড়েছে যারা দলীয় আদর্শের চেয়ে নিজেদের সুবিধাকে বড় করে দেখে। তারা কখনো ছাত্রলীগ, কখনো শিবির, কখনো আবার ‘স্বতন্ত্র’ বা তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ পরিচয়ে ঘুরে বেড়ায়।
এই পরিস্থিতি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক ভয়ংকর বার্তা দেয়। যখন ছাত্রশিবিরের সাবেক বা বর্তমান কর্মীরা ছাত্রলীগের পরিচয়ে সহিংসতা চালাতে পারে, তখন প্রশ্ন ওঠে—ছাত্ররাজনীতির আদর্শিক ভিত্তি কি আজ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে? নাকি এটাই এখন ‘নতুন বাস্তবতা’, যেখানে আদর্শ নয়, ক্ষমতা, পদ, প্রভাব, আর ফায়দা হয়ে উঠেছে ছাত্ররাজনীতির মূল চালিকাশক্তি?
এই নব্য গুপ্ত রাজনীতির মুখোশ উন্মোচনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, রাজনৈতিক সংগঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করে, বরং তদবিরের পুতুলে পরিণত হয়, তাহলে সেই বিশ্ববিদ্যালয় আর শিক্ষার স্থান থাকে না। তদ্বিপরীত, তা পরিণত হয় ক্ষমতাবানদের ‘ক্লাব হাউজ’-এ, যেখানে পেছনের দরজা দিয়ে শত্রু ঢুকে পড়ে বন্ধু সাজে।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক সংগঠনগুলোরও আত্মসমালোচনা জরুরি। শুধুমাত্র ক্ষমতার মোহে যদি তারা আদর্শহীন লোকজনকে নিজেদের মধ্যে জায়গা দেয়, তবে তারা নিজেই নিজের কবর রচনা করছে। কাদেরের অভিযোগ অনুসারে, শিবিরের পরিচয়ে যারা ছাত্রলীগের ভেতরে প্রবেশ করে, তারাই একসময় ছাত্রলীগকে গিলে খায়—ঠিক যেমন ক্যান্সার শরীরকে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলে।
সবশেষে, সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এই ছাত্রসমাজই একদিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ১৯৬৯ সালে, ১৯৯০ সালে, এমনকি সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোতেও। তাই আজ যখন ছাত্ররাজনীতির ছদ্মবেশী চরিত্রগুলো একের পর এক উন্মোচিত হচ্ছে, তখন তারাই হতে পারে সবচেয়ে বড় নিয়ামক।
যদি শিক্ষার্থীরা আর নির্বাক না থাকে, যদি তারা পরিচয়ের চেয়ে কাজকে মূল্যায়ন করে, আর যদি তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সত্যের পাশে দাঁড়ায়—তাহলে এই ছায়া চরিত্ররা আর বেশিদিন টিকতে পারবে না।
আপনার মতামত জানানঃ