বাক্স্বাধীনতা আসলেই কারও কারও পৈতৃক সম্পত্তি। বলতে বা শুনতে যতই খারাপ লাগুক, এটাই সত্যি। তাই বিরোধীদলীয় লোকজন কিংবা দেশে বা বিদেশে অবস্থানকারী কেউ মুখ খুললে মামলা খাওয়া মোটামুটি নিশ্চিত, আত্মীয়স্বজনের হয়রানিটাও উপরি। শুরুতে মামলা হতো তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায়, এরপর এল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, আর এখন চলছে সাইবার নিরাপত্তা আইনের যুগ। সর্বশেষ ময়মনসিংহ পুলিশ এক কবি ও শিল্পীকে গ্রেপ্তারে ৫৪ ধারাও প্রয়োগ করেছে।
কোনো দিন শুনেছেন, ভিন্নমতাবলম্বী কারও মানহানির জন্য এসব আইনে মামলা হয়েছে? তাঁদের কি মান নেই? না, তাঁদের মানহানিতে কারও মনে ব্যথা লাগে না? ওহ, এখন তো আবার বাক্স্বাধীনতার আলোচনায় নতুন শব্দমালা যুক্ত হয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বীরা কিছু বললে-লিখলে-আঁকলে এমনকি অঙ্গভঙ্গি করলেও সেটা অপতথ্য বা ভুয়া তথ্য। আর সরকার, তার মন্ত্রী-সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে চ্যালাচামুণ্ডারা যা বলবে সব বাক্স্বাধীনতা, সেগুলো তত্ত্ব ও তথ্য।
ময়মনসিংহের ঘটনাটা শোনেন। গত রোববার রাতে কবি ও গ্রাফিক ডিজাইনার শামীম আশরাফ আটক হন। ময়মনসিংহের প্রাগ্রসর তরুণদের যে দলটি লিখে-বলে-এঁকে প্রতিবাদটা জারি রাখতে চান, তিনি তাঁদের একজন। তো তাঁকে পুলিশ ‘সন্দেহজনক’ ভেবে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, পোস্টার ডিজাইনের মাধ্যমে তিনি ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র একরামুল হক টিটুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছেন।
কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আনোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘মেয়র প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র একরামুল হক টিটুকে নিয়ে পোস্টার তৈরি করায় এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে শামীমকে আটক করা হয়েছে।’ শামীমের পোস্টারের ভাষ্য ছিল, ‘হোল্ডিং ট্যাক্সের পাহাড়সম বোঝা কেন সাধারণ মানুষের ওপর চাপাও?’/ ‘দেশে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে ঠিকাদার ১ জন, মালিক ১ জন, শাসকও ১ জন’/ ‘আপনি জানেন কি? ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের সড়ক উন্নয়ন ও ড্রেনেজ নেটওয়ার্কসহ নাগরিক সেবা উন্নতকরণ প্রকল্পে ১৫৭৫ কোটি টাকার মধ্যে, ৩০০ কোটির টাকার কাজ হয়েছে।’ একদিন পর শামীম জামিনে মুক্তি পেয়েছেন সাইবার নিরাপত্তা আইনের মামলাসহ।
এই যে মুখ চেপে ধরার সংস্কৃতি, তাতে লাভবান হচ্ছে কে? লুৎফুন্নাহার লুমার কথা মনে আছে? কোটা সংস্কার আন্দোলনে মিছিলের মুখ ছিলেন। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় গোলাপি সালওয়ার-কামিজ পরে নেকাবে মুখ ঢেকে এক নারী ফেসবুকে হাজির হলেন। তিনি বললেন, ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ অফিসে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটেছে।
ওই দিন সন্ধ্যা থেকে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হলো যে ওই নারীই লুৎফুন্নাহার লুমা। কারণ, তাঁর ওই একই রঙের পোশাক আছে। আর যায় কোথায়?
ঘুমন্ত লুৎফুন্নাহারকে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানা থেকে পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে আসল। আজ পর্যন্ত কিন্তু সেই গোলাপি সালোয়ার-কামিজ পরা নারীকে পুলিশ শনাক্ত করতে পারেনি। তাতে কি? লুৎফুন্নাহারকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, জেল খাটতে হয়েছে। একপর্যায়ে তিনি রাজনীতি থেকে সরে গেছেন। আমরা একজন সম্ভাবনাময় নারীকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে হারিয়ে যেতে দেখলাম।
ওই একই সময় নুসরাত জাহান সোনিয়া নামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক গ্রেপ্তার হন । ছয় বছর হলো তিনি আর স্কুলে ফিরে যেতে পারেননি।
শরীয়ত বয়াতি গ্রেপ্তার হন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায়। গান গেয়ে জেলে গেছেন। এই বয়াতিদের কথাই না বলে গেছেন আবদুল লতিফ, ‘যে শুইনাছে আমার দেশের গাঁওগেরামের গান/ নানান রঙের নানান রসে, ভইরাছে তার প্রাণ/ যপ-কীর্তন, ভাসান-জারি, গাজীর গীত আর কবি সারি/ আমার এই বাংলাদেশের বয়াতিরা নাইচা নাইচা কেমন গায়।’?
মনে আছে আদালত প্রাঙ্গণে তোলা তাঁর ছবিটা? হাতকড়া পরা শিল্পীর পাশে উর্দি পরা পুলিশ। শরীয়ত বয়াতি বলেন, মাস দুয়েক পরপর মামলার তারিখ পড়ে, অন্তত একদিন আগে ঢাকায় আসতে হয়। ঢাকায় আসা, থাকা, আদালতে যাওয়া-আসায় অনেক খরচ। নিজের এলাকায় খুবই ব্যস্ত ও জনপ্রিয় গায়ক ছিলেন। আগের মতো স্বাধীনভাবে গাইতে পারেন না, নানা বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, বিতার্কিক ও উপস্থাপক খাদিজাতুল কুবরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, যাঁরা তাঁর জন্য আন্দোলন করেছেন, তাঁদের একটা ধন্যবাদ জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতেও ভয় হয় তাঁর। বাংলাদেশ রাজনৈতিক নেতা, গায়ক, শিক্ষক, বিতার্কিক, অগুনতি সাংবাদিকসহ প্রতিশ্রুতিশীল কত মানুষকে হারাল!
এখন চলুন দেখি উল্টো পিঠে কী হতে পারত। লুৎফুন্নাহার আশঙ্কা করছিলেন, তাঁকে বিপদে ফেলা হতে পারে। সাইবার পুলিশের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কী করলেন? লুৎফুন্নাহারকে নিয়ে যাঁরা ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছিলেন, কেন তাঁদের শনাক্ত না করে লুৎফুন্নাহারের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাঁকে জেলে পাঠালেন। প্রকৃত গুজব রটনাকারীরা গ্রেপ্তার হলো না কেন?
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল গুজব ছড়ানোর। ওই দিন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল কেন? কার স্বার্থে? তথ্য না পেলে গুজব ছড়ায়, এটা কে না জানে? যারা মানুষের তথ্য পাওয়ার অধিকারে বাধা দিয়েছিল, তাদের কিছু হলো না কেন? উল্টো আমরা দেখলাম নির্বাচনের আগের দিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন বা বিটিআরসি থ্রি-জি, ফোর-জি বন্ধ করে দেয়, আর নির্বাচনের দিন ইন্টারনেটই ছিল না।
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভানেত্রী লাকী আক্তারের বাসা থেকে সাদাপোশাকে ডিবি কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা এপিএম সুহেলকে গ্রেপ্তার করে মধ্যরাতে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগের ছোট ভাই হওয়ায় সুহেল সে রাতে লাকীদের বাসায় ছিলেন। এর পরদিনই একটি ভুঁইফোড় সংবাদ পোর্টালে আপত্তিকর একটা ছবি দিয়ে সুহেল গ্রেপ্তারের খবর প্রচার করে কে বা কারা।
প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁরা সে রাতে লাকীদের বাসায় গিয়েছিলেন, তাঁরা ছাড়া এই ছবি আর কারও পক্ষে ছড়ানো সম্ভব না। লাকী বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, প্রথম আলোয় খবরও প্রকাশ হয়েছিল। যাঁরা ছবি তুলে ছড়ালেন, তাঁদের কেন কিছু হলো না? নাকি লাকীদের মান থাকতে নেই?
সেই উনিশ শতকে ব্রিটিশ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গঠনমূলক যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কোনো ভাবনা বা মত ধামাচাপা দেওয়ার অর্থ সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া। সত্যে পৌঁছানোর সর্বোত্তম উপায় হলো নানা মত ও পথের প্রতিযোগিতা। যদি কোনো মত ও পথে তিলমাত্র সত্য থাকে, তা প্রকাশ হতে না দেওয়ার মানে ওই পরিমাণ সত্য তথ্য জানা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা। সেই বিবেচনায় এমনকি অসার ভাবনাও ঠিক অসার নয়, তাকে চেপে ধরার চেষ্টাও অনুচিত। কিন্তু আমাদের রাজা-রানিরা শিকল পরাতে ভালোবাসেন।
এই নিষ্পেষণে যাঁরা অতিষ্ঠ, তাঁরা এই কথা ভেবে শান্তি পেতে পারেন যে জেলে ঢোকালেই মান হানি হয় না। তো, আসুন, আপাতত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে মন দিয়ে আবদুল লতিফের ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায় গানটি শুনি। ওই গানেই আছে,‘মনে কইরা তরার কথা কান্দে বনের তরু লতা, তাই তো ঘরে ঘরে কত মা তায় চোখের জলে বুক ভাসায়।…ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়…।” সূত্র: প্রথম আলো।
আপনার মতামত জানানঃ