
ভারতের ব্যবসা জগতে একসময় যে নামটি ছিল আকাশচুম্বী—তিনি অনিল আম্বানি। রিলায়েন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি একসময় ছিলেন দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একজন। কিন্তু আজ সেই নামই আলোচনায় এসেছে অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে। ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) অনিল আম্বানির ৩ হাজার কোটি রুপিরও বেশি মূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে। এই ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে কর্পোরেট দুর্নীতি, প্রভাবশালী পরিবারগুলোর ব্যবসা পরিচালনা ও অর্থ পাচারের বিষয়গুলো।
ইডির এই পদক্ষেপ এসেছে প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট (পিএমএলএ) অনুযায়ী। তদন্ত সংস্থাটি গতকাল চারটি প্রাথমিক আদেশ জারি করেছে। এতে মুম্বাইয়ের বিলাসবহুল পালি হিল এলাকার আম্বানির বাড়িসহ রিলায়েন্স গ্রুপের একাধিক আবাসিক ও বাণিজ্যিক সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে। শুধু মুম্বাই নয়, দিল্লি, নয়ডা, গাজিয়াবাদ, পুনে, থানে, হায়দরাবাদ, চেন্নাই ও পূর্ব গোদাবরীর মতো শহরেও এই সম্পত্তি রয়েছে। এক কথায় বলা যায়, ভারতের প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এক বিশাল সম্পদ সাম্রাজ্যে ইডির এই অভিযান আঘাত হেনেছে।
ইডি জানায়, এই মামলার তদন্ত শুরু হয়েছিল মূলত আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ থেকে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া বিশাল পরিমাণ ঋণ যথাযথভাবে ব্যবহার না করে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠে। গত আগস্টে অনিল আম্বানিকে ইডি জিজ্ঞাসাবাদও করে। সে সময় তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু তদন্তে প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, তার মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন কিছু কোম্পানির মাধ্যমে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে, যার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ইডির হাতে এসেছে।
একসময় ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন অনিল আম্বানি। রিলায়েন্স গ্রুপের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ এবং টেলিকম, ইনফ্রাস্ট্রাকচার, পাওয়ারসহ নানা খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে তিনি দ্রুত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায় ব্যর্থতা, ভুল বিনিয়োগ এবং ঋণের ভারে তার সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। ২০২০ সালে তিনি আদালতে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি দেউলিয়া। তবে ইডির মতে, তার নামে বা ছদ্মনামে এখনো বিপুল সম্পদ রয়েছে, যা বৈধ উৎসে অর্জিত নয়।
এই মামলার মাধ্যমে ভারতের কর্পোরেট জগতে এক ধরনের বার্তা গেছে—অর্থনৈতিক অপরাধে যত বড় নামই হোক, রেহাই নেই। ইডির আগের তদন্তগুলোতেও দেখা গেছে, দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে। অর্থ পাচারের মতো অপরাধে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বেশ কড়াকড়ি অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে কালোটাকা ও অবৈধ অর্থপ্রবাহ রোধে কঠোর অভিযান চলছে।
অর্থ পাচারের মতো অপরাধ শুধু একটি ব্যক্তির বিষয় নয়, এটি গোটা অর্থনীতির জন্য হুমকি। এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অস্বচ্ছতা বাড়ে, বৈধ ব্যবসাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রাষ্ট্রের রাজস্ব হারিয়ে যায়। অনিল আম্বানির মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ ভারতের অর্থনৈতিক শুদ্ধতার পথে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে, সমালোচকদের মতে, এমন অভিযানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। কারণ, ভারতের অনেক বড় ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন। তাই ইডির মতো সংস্থার কার্যক্রম নিরপেক্ষ রাখা অত্যন্ত জরুরি। ন্যায়বিচার তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তদন্তের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন হয়।
অনিল আম্বানি নিজে এখনো প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি। তবে তার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো দাবি করেছে, ইডির অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং এই সম্পত্তিগুলো বৈধ ব্যবসায়িক বিনিয়োগের ফল। তারা বলছে, আদালতে প্রমাণ উপস্থাপন করা হলে সত্য প্রকাশ পাবে।
তবে যে বিষয়টি নিশ্চিত, এই ঘটনার মাধ্যমে ভারতের ব্যবসায়িক অঙ্গনে নতুন করে এক আলোচনার জন্ম হয়েছে—বিলাসিতা, প্রভাব ও সম্পদের আড়ালে থাকা অনিয়ম আর কতদিন আড়ালে থাকবে? অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সুস্থ রাখতে হলে শুধু আইন নয়, নৈতিকতার চর্চাও সমান জরুরি। অনিল আম্বানির এই ঘটনা হয়তো ভবিষ্যতের উদ্যোক্তাদের জন্য এক সতর্কবার্তা—অর্থের জৌলুসের চেয়ে সততার ভিত্তি দীর্ঘস্থায়ী।
এই মামলার চূড়ান্ত রায় যা-ই হোক, এটি স্পষ্ট যে ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কতটা কঠোরভাবে সরকার অর্থনৈতিক অপরাধ দমন করতে পারে তার ওপর। একসময় যারা দেশকে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারাই যদি সেই ব্যবস্থার অপব্যবহার করেন, তাহলে সেই সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই অনিল আম্বানির এই জব্দকরণ কেবল একজন ব্যবসায়ীর পতনের গল্প নয়, বরং এটি ভারতের আর্থিক সততার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
	
	
	
	
	
আপনার মতামত জানানঃ