ইউক্রেনের চেরনোবিল নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধ্বংস, নীরবতা আর এক অদৃশ্য ভয়—তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ছায়া। ১৯৮৬ সালের সেই ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর এই অঞ্চল এখনো নিষিদ্ধ, কিন্তু প্রকৃতি সেখানে নতুন জীবনের গল্প লিখছে। সম্প্রতি সেই গল্পে যোগ হয়েছে এক অদ্ভুত অধ্যায়—নীল রঙের কুকুর।
সম্প্রতি চেরনোবিল নিষিদ্ধ অঞ্চলে কাজ করা ‘ডগস অব চেরনোবিল’ নামের এক অলাভজনক সংস্থা তাদের নির্বীজন কার্যক্রমের সময় হঠাৎ তিনটি কুকুরকে পুরোপুরি নীল রঙে দেখতে পায়। এই কুকুরগুলোকে ধরতে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা অবাক হয়ে যান—তাদের চামড়া, লোম সবই নীলচে, যেন কোনো কার্টুন চরিত্রের রঙ। সংস্থাটি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে লিখেছে, “আমরা কুকুর ধরার কাজ করছিলাম। হঠাৎ তিনটি সম্পূর্ণ নীল কুকুর দেখতে পেলাম। আমরা জানি না কী ঘটছে।” খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়।
চেরনোবিল এখন প্রায় সাতশোরও বেশি কুকুরের আবাস। এরা সেইসব পোষা প্রাণীর বংশধর, যাদের মালিকরা দুর্ঘটনার পর দ্রুত এলাকা ছাড়তে গিয়ে ফেলে গিয়েছিলেন। বছর ঘুরে এরা হয়ে উঠেছে বন্য প্রাণী, তবে অনেকেই এখনো মানুষের আশপাশে থাকে। এই অঞ্চলে কাজ করা কর্মীরা নিয়মিতভাবে তাদের খাবার দেন, চিকিৎসা করেন ও নির্বীজন করেন যাতে তারা নিয়ন্ত্রিতভাবে বংশবৃদ্ধি করে। কিন্তু এভাবে হঠাৎ কিছু কুকুরের শরীরে নীল রঙ দেখা যাওয়া সবাইকে বিস্মিত করেছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রথম ধারণা ছিল—এটি নিশ্চয়ই তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাব। চেরনোবিলের নাম শুনলেই রেডিয়েশন মনে পড়ে, তাই এমন চিন্তা আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দ্রুতই বিজ্ঞানীরা সেই ধারণা বাতিল করেন। ‘ডগস অব চেরনোবিল’ সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেন, “আমরা মনে করছি না এটি রেডিয়েশনের প্রভাব। সম্ভবত কুকুরগুলো কোনো রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে এসেছে।” স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, নীল রঙের উৎস হতে পারে কোনো লিক হওয়া পোর্টেবল টয়লেটের তরল বা কোনো শিল্প বর্জ্য, যা কুকুরগুলো ভুলবশত ঘেঁষে গেছে বা ঘষে নিয়েছে।
অদ্ভুত বিষয় হলো, কুকুরগুলো শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। তারা স্বাভাবিকভাবে দৌড়াচ্ছে, খাচ্ছে ও খেলছে। সংস্থার স্বেচ্ছাসেবকরা জানিয়েছেন, “তাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন নেই, শুধু রঙটা অস্বাভাবিক।” এখন কুকুরগুলোকে ধরার চেষ্টা চলছে, যাতে তাদের রক্ত ও লোমের নমুনা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় আসল কারণ কী।
চেরনোবিলের কুকুরদের গল্প অনেক পুরোনো। পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর সেখানে সব মানুষ সরিয়ে নেওয়া হয়, কিন্তু হাজার হাজার প্রাণী রয়ে যায় পেছনে। অনেককে তখন মেরে ফেলা হয়েছিল, কারণ আশঙ্কা ছিল তারা রেডিয়েশন ছড়াতে পারে। তবু কিছু প্রাণী বেঁচে যায়, আর তাদের বংশধররাই আজকের এই কুকুর। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব কুকুর জেনেটিকভাবে শহুরে কুকুরদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে গেছে। তারা উচ্চ বিকিরণ পরিবেশে নিজেদের টিকে থাকার মতো অভিযোজন গড়ে তুলেছে। তাই চেরনোবিল এখন এক ধরনের ‘বন্য গবেষণাগার’, যেখানে প্রকৃতি নিজেই মানুষের অনুপস্থিতিতে ভারসাম্য খুঁজে নিচ্ছে।
এই নীল কুকুরের ঘটনা তাই শুধু এক অদ্ভুত দৃশ্য নয়, এটি আমাদের সামনে নতুন কিছু প্রশ্নও তুলে ধরেছে। প্রথম প্রশ্ন—মানুষের বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশে কীভাবে প্রভাব ফেলছে? যদি কুকুরগুলো সত্যিই কোনো রাসায়নিক তরলের সংস্পর্শে এসে রঙ পরিবর্তন করে থাকে, তবে সেটা প্রমাণ করে যে নিষিদ্ধ এলাকাটিতেও মানুষের ফেলা বর্জ্য পৌঁছে যাচ্ছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন—এই কুকুরদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? তারা যদি বিষাক্ত পদার্থে স্পর্শ পেয়ে থাকে, তবে তা শুধু তাদের নয়, অন্যান্য প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুকুরগুলোর ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর মানুষজন বিভক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কেউ কেউ মজা করে বলেছে, “চেরনোবিল এখন এক্স-মেন কুকুর তৈরি করছে।” আবার কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, “এটা হয়তো পরিবেশগত বিপদের নতুন ইঙ্গিত।” বিজ্ঞানীরা অবশ্য ঠান্ডা মাথায় বলছেন, “অতীতের ভয়ের মতো তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না।” তারা এখন অপেক্ষা করছেন পরীক্ষাগার বিশ্লেষণের জন্য, যাতে বোঝা যায় এটি শুধু রঙিন রাসায়নিক নাকি কোনো জৈব প্রতিক্রিয়া।
এই ঘটনা আবারও আমাদের মনে করিয়ে দিল চেরনোবিল কেবল ইতিহাসের একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং আজও তা জীবন্ত এক পাঠশালা। ১৯৮৬ সালে বিস্ফোরিত পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর ৪ নম্বর ইউনিটের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিকিরণ ছড়াচ্ছে, কিন্তু এর আশপাশের বনভূমিতে প্রাণীরা ফিরে এসেছে। হরিণ, বন্য ঘোড়া, এমনকি নেকড়েও এখন সেখানে দেখা যায়। এই কুকুরগুলোও সেই পুনর্জীবনের প্রতীক—যারা বিপর্যয়ের ছাই থেকে বেঁচে থেকেও নতুন প্রজন্ম গড়েছে।
মানুষের অনুপস্থিতিতে প্রকৃতি নিজের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছে, কিন্তু মানুষেরই তৈরি নতুন বিপদ—রাসায়নিক বর্জ্য, অযত্ন ও পরীক্ষাহীন শিল্পপণ্য—সেই ভারসাম্যকে আবার নষ্ট করছে। নীল কুকুরের ঘটনা হয়তো তেমনই এক সতর্ক সংকেত।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই ঘটনাটি একদিকে যেমন বৈজ্ঞানিক কৌতূহল সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে এটি মানুষের আবেগকেও নাড়া দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, “এই কুকুরগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, মানুষ ভুল করলে তার প্রভাব প্রকৃতি বহন করে।” আবার কেউ বলছেন, “চেরনোবিলের মতো জায়গায়ও জীবন টিকে থাকে—যেভাবেই হোক।”
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা কুকুরগুলোকে ধরে পরীক্ষা করার চেষ্টা করছেন। তাদের লোম, রক্ত ও মাটির নমুনা বিশ্লেষণ করা হবে। যদি প্রমাণ মেলে যে রাসায়নিক সংস্পর্শই এর কারণ, তাহলে এলাকা পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু যদি অন্য কিছু পাওয়া যায়, তাহলে তা হতে পারে নতুন এক গবেষণার সূচনা।
চেরনোবিলের কুকুরগুলো বহু বছর ধরে মানুষের সহানুভূতির প্রতীক হয়ে আছে। স্বেচ্ছাসেবকেরা তাদের খাওয়ান, টিকা দেন, এমনকি দত্তক নেন। তাদের মধ্যে এই নীল রঙের কুকুরগুলো এখন আলাদা নজর কাড়ছে—একটি রহস্য, একটি বার্তা নিয়ে। হয়তো এটি কোনো বিপদের ইঙ্গিত নয়, বরং প্রকৃতির অদ্ভুত খেলাই। কিন্তু তবুও এটি আমাদের শেখায়, মানুষ যত দূরেই সরে যাক, তার প্রভাব প্রকৃতির ওপর থেকে মুছে যায় না।
চেরনোবিলের নীল কুকুর এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়। বিজ্ঞানীরা কারণ খুঁজবেন, সাংবাদিকরা গল্প লিখবেন, মানুষ ছবি শেয়ার করবে—কিন্তু হয়তো কুকুরগুলো এসব কিছুই জানে না। তারা শুধু বেঁচে আছে, নিজেদের মতো করে, এক নীরব, নীল পৃথিবীতে।
আপনার মতামত জানানঃ