
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়ে, যেখানে পুরনো দলগুলো নতুন করে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির মধ্যে পার্থক্যটি এখন স্পষ্ট। জামায়াত অনেক আগে থেকেই মাঠে নেমে পড়েছে, আর বিএনপি এখনো প্রার্থীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, কেন জামায়াত এগিয়ে যাচ্ছে, অথচ বিএনপি পিছিয়ে পড়ছে।
জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান অতীতে বিতর্কিত হলেও তাদের সাংগঠনিক কাঠামো বরাবরই ছিল শক্ত। দলটি গত এক বছরে ধীরে ধীরে পুনরায় সংগঠিত হয়েছে। নিষিদ্ধ অবস্থায়ও তারা সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় থেকেছে। বিভিন্ন জেলায় তাদের মহিলা শাখা ঘরে ঘরে গিয়ে নারী ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তারা মানুষের সমস্যা শোনে, ধর্মীয় আলোচনা করে এবং স্থানীয় পর্যায়ে উপস্থিতি টিকিয়ে রাখছে। কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকায় জামায়াতের কর্মীরা এখন প্রকাশ্যে প্রচারে নেমেছেন। পুরুষ সদস্যরা মসজিদে মুসল্লিদের সঙ্গে কথা বলছেন, বাজারে সভা করছেন। এতে দলের প্রতি স্থানীয় মানুষের একধরনের আস্থা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের পুনর্গঠন নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও মাঠের কাজে পিছিয়ে পড়েছে। দলের শীর্ষ নেতারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে নানা সভা-সমাবেশ করলেও স্থানীয় পর্যায়ে তা তেমন প্রভাব ফেলছে না। একদিকে জামায়াত নির্বাচনী প্রস্তুতিতে এগিয়ে আছে, অন্যদিকে বিএনপি মনোনয়ন, প্রার্থী বাছাই এবং দলীয় কোন্দল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। দলের একাধিক নেতার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, গত এক বছরে হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। কোথাও কোথাও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও হয়েছে, যা ভোটারদের চোখে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে অন্তত ৫৮ জন নিহত হয়েছেন। এই সহিংসতা শুধু দলীয় ক্ষতি নয়, বরং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। নরসিংদীতে সম্প্রতি গুলিতে একজন যুবদল নেতা নিহত হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানাকে “বহিরাগত” বলে বিরোধিতা করছে স্থানীয় নেতারা। চট্টগ্রামের রাউজানে দলীয় সংঘর্ষে ১৫ জন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এসব ঘটনায় দলীয় ঐক্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিএনপি নেতৃত্ব এখন বলছে, তারা মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনসম্পৃক্ততাকে প্রাধান্য দেবে। কিন্তু কথায় আর কাজে পার্থক্য থেকেই যাচ্ছে। দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আসনে একাধিক প্রার্থী রয়েছেন, ফলে কে প্রার্থী হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হয়েছে। অনেক স্থানে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মনে করেন, শক্তি দেখাতে পারলেই প্রার্থী হওয়া সহজ হবে। ফলে তৃণমূলের মধ্যে অসন্তোষ ও বিভক্তি দেখা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দলের একাধিক শীর্ষ নেতা এখন অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নেমেছেন, কিন্তু সংগঠন এখনও ছন্দে ফিরতে পারেনি।
অন্যদিকে জামায়াত অনেক দ্রুত নিজেদের ঘুরে দাঁড় করাচ্ছে। তারা দীর্ঘদিন রাজনীতির বাইরে থাকলেও সংগঠনকে নতুনভাবে সাজিয়েছে। তরুণ নেতৃত্বকে সামনে এনে অনেক জায়গায় প্রবীণদের পরিবর্তে নতুন প্রজন্মের নেতাদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এতে দলের ভেতরে নতুন উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। তারা এখন আর শুধু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নয়, সামাজিক বাস্তবতা নিয়েও কথা বলছে। ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনছে, সাহায্য করছে, এমনকি বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতেও নিজেদের অবস্থান জানাচ্ছে। এতে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তাদের ভাবমূর্তি আগের তুলনায় কিছুটা বদলেছে।
বিএনপির দেরি করার অন্যতম কারণ হলো তাদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন। দলের অভ্যন্তরে এখনো অনেকেই ভাবেন, দলীয় সিদ্ধান্তে তাদের মতামত গুরুত্ব পায় না। সম্মেলন না হওয়া, তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব নির্বাচন না করা এবং বারবার স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তে নির্ভরশীল থাকা দলের গণতান্ত্রিক চর্চাকে দুর্বল করেছে। অনেকে মনে করেন, এটি বিএনপির বড় দুর্বলতা। দলের ভেতর গণতন্ত্র না থাকলে দেশের জন্য গণতন্ত্রের দাবিও দুর্বল হয়ে যায়।
আরেকটি বড় পার্থক্য হলো মাঠে অবস্থান। জামায়াতের কর্মীরা গ্রামে, হাটে-বাজারে সক্রিয়। বিএনপির কর্মীরা এখনো কেন্দ্রের নির্দেশের অপেক্ষায়। রাজধানী ঢাকায় মাঝে মাঝে বড় সমাবেশ করলেও সারা দেশে তাদের উপস্থিতি আগের মতো শক্ত নয়। এমনকি অনেক জেলায় স্থানীয় কমিটি গঠনও অসম্পূর্ণ। দলটি এখনো প্রার্থীদের নিয়ে জরিপ ও সমন্বয়ের কাজ করছে। অনেক স্থানে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার আশঙ্কাও আছে। ফলে প্রার্থী ঘোষণা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
জামায়াত আবারও নারী ভোটারদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। তাদের মহিলা শাখা ঘরে ঘরে গিয়ে যোগাযোগ করছে, যা বিএনপি অনেক পরে শুরু করেছে। বিএনপি ঘোষণা করেছে যে তারা ১৪ অক্টোবর খুলনা থেকে নারীসম্পৃক্ত কর্মসূচি শুরু করবে। কিন্তু এত দিন দেরি কেন—এই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
বিএনপি নেতারা এখন বলছেন, তাদের প্রার্থী বাছাইয়ে আর্থিক সামর্থ্যের চেয়ে আন্দোলনে সক্রিয়তা ও জনসম্পৃক্ততাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। কিন্তু অতীতে দেখা গেছে, এসব নীতিগত সিদ্ধান্ত মাঠে বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়। অনেক সময় প্রভাবশালী নেতারা নিজের অবস্থান ধরে রাখেন, ফলে তরুণ বা তৃণমূলের কর্মীরা পিছিয়ে পড়েন।
অন্যদিকে জামায়াত খুব সংগঠিতভাবে নিজেদের প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের পোস্টার, প্রচার, এমনকি অনলাইন উপস্থিতিও বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা ধারাবাহিকভাবে নিজেদের বার্তা ছড়াচ্ছে। এতে তরুণ ভোটারদের মধ্যে তাদের কিছুটা প্রভাব বাড়ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিএনপির সমস্যা মূলত সমন্বয়ের অভাব ও নেতৃত্ব সংকটে। তারা আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিলেও সংগঠনগতভাবে প্রস্তুত নয়। দলীয় ঐক্য ফিরিয়ে আনা ও স্থানীয় পর্যায়ে আস্থা তৈরি করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে জামায়াত ছোট দল হয়েও সংগঠনের শৃঙ্খলার কারণে ধীরে ধীরে প্রভাব বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে উভয় দলের জন্য সময় এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত যদি তাদের কৌশল ধরে রাখতে পারে, তারা হয়তো মাঠে নিজেদের দৃশ্যমানতা আরও বাড়াতে পারবে। আর বিএনপি যদি দ্রুত নিজেদের কোন্দল মিটিয়ে জনসম্পৃক্ততায় ফিরে আসে, তবে তারা আবারও রাজনীতিতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত চিত্রটি বলছে, জামায়াত এগিয়ে, আর বিএনপি সেই গতিতে পিছিয়ে পড়ছে।
এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র দুটি দলের নয়, বরং দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন। যেখানে সংগঠন, নেতৃত্ব, এবং সময়মতো সিদ্ধান্তই ঠিক করে দেয় কে এগিয়ে যাবে, আর কে পিছিয়ে থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ