ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসু নির্বাচনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস)-এর ভরাডুবি নিছক একটি নির্বাচনী পরাজয় নয়, বরং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অক্ষমতার প্রকৃষ্ট প্রতিচ্ছবি। যে দলটি তরুণদের রাজনীতির মুখপাত্র হওয়ার দাবি করছে, তারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাঙ্গনের নির্বাচনে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতেই ব্যর্থ হয়েছে। একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এনসিপির জন্য ছাত্ররাজনীতি ছিল নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি ভিত্তি গড়ে তোলার সুযোগ। কিন্তু সেই সুযোগ তারা হারিয়েছে, বরং নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলো আরও নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে।
এনসিপির এই ব্যর্থতার মূল কারণ হলো সংগঠনের দুর্বলতা। বাগছাস ভোটের আগে ছাত্রদের মধ্যে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, তৃণমূল পর্যায়ে তাদের কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন, প্রচার কিংবা ছাত্র-স্বার্থের কোনো বড় ইস্যু তারা তুলতে পারেনি। প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলো যেখানে সাংগঠনিক শক্তি এবং অভিজ্ঞ নেতৃত্বের মাধ্যমে ভোটারদের আকৃষ্ট করেছে, সেখানে বাগছাস তাদের প্রার্থীদের পরিচিত করাতেই হিমশিম খেয়েছে। ফলাফল খুবই স্বাভাবিকভাবে এসেছে—ছাত্রসমাজ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।
এরপরও এনসিপি নেতৃত্ব ব্যর্থতাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। দলের দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ দাবি করেছেন যে এটা ভরাডুবি নয়, বরং শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা। কিন্তু বাস্তবে এটি আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু নয়। যে সংগঠন মূল ক্যাম্পাসে প্রার্থীদের দাঁড় করিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য পদে জিততে পারে না, সেটির ভরাডুবি হয়েছে—এটাই সত্য। নেতৃত্বের পক্ষ থেকে আত্মসমালোচনা না করে দায় এড়ানোর প্রবণতা ভবিষ্যতে দলটির জন্য আরও ভয়াবহ হতে পারে।
এনসিপির দুর্বলতার আরেকটি বড় কারণ হলো আদর্শগত শূন্যতা। তারা কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। দলটি মূলত বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে কাজে লাগিয়ে সুযোগ নেওয়ার কৌশল নিয়েছে। কিন্তু তরুণরা যে স্পষ্ট আদর্শ, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং দিকনির্দেশনা চায়, সেটি এনসিপি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ছাত্রসমাজ তাদের একটি ভাসমান ও সুবিধাবাদী সংগঠন হিসেবে দেখছে, যার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কোনো আস্থা বা সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এনসিপি আরও ব্যর্থ হয়েছে। ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কর্মক্ষম, সক্রিয় এবং ত্যাগী প্রার্থী তারা দাঁড় করাতে পারেনি। নির্বাচনী মাঠে তাদের প্রার্থীরা ছিলেন অচেনা মুখ, যাদের পক্ষে কার্যকর প্রচারণা গড়ে ওঠেনি। এতে বোঝা যায়, এনসিপি নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্যকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন সম্ভব হয়নি। ছাত্ররাজনীতিতে নেতৃত্বের গুণাবলি না থাকলে কোনো সংগঠন টেকসই হয় না, এনসিপি সেই পরীক্ষায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
এনসিপি নেতারা দাবি করছেন ডাকসু-জাকসুর এই ফলাফল জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু ইতিহাস বলে, ছাত্ররাজনীতিতে শক্তি প্রদর্শন করতে না পারলে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করা যায় না। তরুণ প্রজন্ম ভোটার তালিকায় একটি বড় অংশ। তারা যদি এনসিপিকে গুরুত্ব না দেয়, তবে জাতীয় নির্বাচনে এই দলের টিকে থাকা দুরূহ হবে। ডাকসু ও জাকসুর এই ভরাডুবি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে এনসিপি এখনো মূলধারায় প্রবেশ করতে পারেনি, বরং প্রান্তিক অবস্থানে ঘুরপাক খাচ্ছে।
এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এনসিপি তাদের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে সেটিকে বার্তা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। এই প্রবণতা তাদের রাজনৈতিক পরিপক্বতার অভাবকেই প্রকাশ করছে। ব্যর্থতাকে ব্যর্থতা হিসেবে স্বীকার না করলে ভবিষ্যতের প্রস্তুতি কখনোই সঠিকভাবে নেওয়া সম্ভব নয়। এনসিপি যদি এখনো আত্মসমালোচনায় না যায়, তাহলে জাতীয় নির্বাচনে তাদের আরও বড় ভরাডুবি ঘটবে।
ডাকসু-জাকসুর এই ফলাফল তাই এনসিপির জন্য একটি সতর্কবার্তা। তারা যদি নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তুলতে না পারে, ছাত্রসমাজের আস্থা অর্জন না করতে পারে এবং স্পষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ সামনে না আনে, তাহলে জাতীয় রাজনীতিতে তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। বরং তারা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়বে এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় একটি ব্যর্থ পরীক্ষামূলক দলের নাম হিসেবেই থেকে যাবে।
আপনার মতামত জানানঃ