মঙ্গল গ্রহে জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম উত্তেজনাপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাসার পারসিভারেন্স রোভার গত কয়েক বছর ধরে জেজেরো গর্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শিলা সংগ্রহ করছে এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা কৌতূহলী হয়ে উঠছেন এই গ্রহের অতীত নিয়ে। সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলো ইঙ্গিত করছে যে মঙ্গল একসময় জীবনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছিল এবং সেখানকার কিছু খনিজ ও জৈব পদার্থ হয়তো প্রাচীন জীবনের অস্তিত্বের ইঙ্গিত বহন করছে। এই আলোচনায় আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করব আবিষ্কারের প্রেক্ষাপট, শিলার গঠন, প্রমাণের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা, এবং ভবিষ্যতের গবেষণা পরিকল্পনা।
প্রথমেই উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ব্রাইট অ্যাঞ্জেল নামে পরিচিত এক বিশেষ শিলা। রোভার যখন এটিকে বিশ্লেষণ করে, তখন দেখা যায় এর ভেতরে জৈব যৌগের উপস্থিতি রয়েছে। জৈব যৌগ বা অর্গানিক কম্পাউন্ড হলো জীবনের মূল উপাদান, যা কার্বনভিত্তিক অণুর মাধ্যমে গঠিত। এগুলো পৃথিবীতে জীবনের বিকাশের জন্য অপরিহার্য ছিল। শুধু তাই নয়, শিলাটির মধ্যে পানি প্রবাহের প্রমাণও পাওয়া গেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে একসময় মঙ্গলে তরল পানি ছিল। এই পানি জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে মৌলিক শর্ত।
এই শিলার মধ্যে চিতাবাঘের মতো দাগ লক্ষ্য করা গেছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল, যা হয়তো অণুজীব থেকে তৈরি হয়েছে। যদিও এটি শতভাগ প্রমাণ নয়, তবে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ধরন বিজ্ঞানীদের আশাবাদী করে তুলছে। তারা মনে করছেন, কাদা ও জৈব পদার্থের মিথস্ক্রিয়ায় যে খনিজ পদার্থ তৈরি হয়েছে, তা জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত বহন করে। একইসঙ্গে তারা সতর্কও করেছেন যে এসব প্রমাণ সম্পূর্ণভাবে অজৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কারণেও হতে পারে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো বৈজ্ঞানিক সতর্কতা। গবেষকরা জানাচ্ছেন, মঙ্গলে জীবনের উপস্থিতি প্রমাণ করা সহজ নয়। যে খনিজ পদার্থ পাওয়া গেছে, সেগুলো অজৈব পরিবেশেও তৈরি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবীতেও অনেক সময় অজৈব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্বন-ভিত্তিক যৌগ তৈরি হয়। তাই এটি জীবনের উপস্থিতির চূড়ান্ত প্রমাণ নয়। কিন্তু গবেষকরা যেসব নতুন শিলা আবিষ্কার করেছেন, যেমন স্যাফায়ার ক্যানিয়ন ও ম্যাসোনিক টেম্পলে পাওয়া নমুনা, তা অতীত জীবনের সম্ভাবনাকে আরও শক্তিশালী করেছে।
এই নমুনাগুলোতে ভিভিয়ানাইট ও গ্রেগাইট নামের খনিজ পদার্থ পাওয়া গেছে। এগুলো সাধারণত কাদামাটির সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হয় এবং জীবজগতের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। একই সঙ্গে, শিলার ভেতরে লালচে-বাদামি রঙের চিহ্ন, আয়রন, ফসফেট ও কার্বনভিত্তিক উপাদান পাওয়া গেছে। এগুলো সবই জীবনের জন্য অপরিহার্য উপাদান।
নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক শন ডাফি জানিয়েছেন যে, বিজ্ঞানীরা এক বছরের গবেষণা শেষে সিদ্ধান্তে এসেছেন—এই আবিষ্কারের অন্য কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই নাসা মনে করছে, এটি মঙ্গলে জীবনের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ হতে পারে। যদিও তারা আবারও জোর দিয়েছেন যে চূড়ান্ত নিশ্চিত হওয়ার জন্য নমুনাগুলো পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।
নমুনা সংগ্রহ ও পৃথিবীতে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েও এখন আলোচনা চলছে। নাসা ও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইসা) যৌথভাবে ২০৩৩ সালের মধ্যে এই নমুনাগুলো পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার একটি মিশন হাতে নিয়েছে। এর জন্য একটি ছোট রকেটবাহী মহাকাশযান ব্যবহার করা হবে। পৃথিবীর উন্নত গবেষণাগারে নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করলেই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হবে যে এগুলো জীব থেকে তৈরি, নাকি নিছক প্রাকৃতিক রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফল।
এখানে আরেকটি বৈজ্ঞানিক দিক উল্লেখযোগ্য। শিলার গঠনে দেখা যাচ্ছে রেডক্স সাইক্লিংয়ের প্রমাণ, যা জীববৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। পৃথিবীতে অনুরূপ গঠন সাধারণত জীবাণুদের উপস্থিতিতে তৈরি হয়। তাই এই ধরনের প্রমাণ বিজ্ঞানীদের কৌতূহল আরও বাড়িয়েছে।
এতকিছুর মধ্যেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—যদি মঙ্গলে সত্যিই জীবন ছিল, তবে তা কতটা উন্নত ছিল? বিজ্ঞানীদের মতে, সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা হলো অণুজীব বা মাইক্রোবিয়াল জীবন। তারা হয়তো নদী ও হ্রদের জলে বিকশিত হয়েছিল, পরে পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে বিলীন হয়ে গেছে। এখন যা অবশিষ্ট আছে তা হলো রাসায়নিক দাগ, খনিজ উপাদান ও জৈব যৌগ।
মঙ্গলে জীবনের অনুসন্ধান শুধু বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়, মানবজাতির ভবিষ্যতের সঙ্গেও যুক্ত। যদি প্রমাণিত হয় যে মঙ্গলে অতীতে জীবন ছিল, তবে তা মহাবিশ্বে জীবনের বিস্তার সম্পর্কে আমাদের ধারণা আমূল বদলে দেবে। এটি প্রমাণ করবে যে জীবন শুধুমাত্র পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মহাবিশ্বে সর্বত্রই জীবন জন্ম নিতে পারে, যদি সঠিক পরিবেশ তৈরি হয়।
বর্তমানের প্রমাণগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও বিজ্ঞানীরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন পৃথিবীতে নমুনা ফিরিয়ে আনার জন্য। আগামী এক দশক এই গবেষণার ক্ষেত্রে নির্ধারক হবে। যদি জেজেরো গর্ত থেকে সংগৃহীত শিলাগুলোতে জীবনের অস্বীকারযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে এটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হবে। আর যদি না-ও হয়, তাহলেও আমরা মঙ্গলের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে নতুন জ্ঞান অর্জন করব।
অতএব বলা যায়, নাসার পারসিভারেন্স রোভারের সাম্প্রতিক আবিষ্কার মঙ্গলে জীবনের সম্ভাবনার একটি নতুন জানালা খুলে দিয়েছে। যদিও এখনই নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়, তবু প্রতিটি নতুন প্রমাণ আমাদের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে একদিন হয়তো আমরা সত্যিই আবিষ্কার করব যে এই লাল গ্রহ একসময় জীবনের আবাস ছিল।
আপনার মতামত জানানঃ