রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের ঘটনাটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক ভয়াবহ সহিংসতা ও সামাজিক অস্থিরতার নজির হয়ে থাকবে। একটি কবরস্থান থেকে মরদেহ তুলে এনে পুড়িয়ে দেওয়া—এই অমানবিক ঘটনা শুধু স্থানীয়ভাবে নয়, পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। একদিকে ধর্মীয় অনুভূতির জটিলতা, অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলার চ্যালেঞ্জ—এই দুইয়ের সংঘাতে রাজবাড়ীর মানুষ রক্তাক্ত হলো, সমাজে ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। এ ধরনের ঘটনা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে—আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের সমাজ কোন পথে হাঁটছে, আর আইন ও ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলা। আশির দশকে তিনি নিজেকে ইমাম মাহাদি দাবি করেছিলেন, যা মুসলিম সমাজের বৃহত্তর অংশ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। দীর্ঘদিন পর তিনি এলাকায় ফিরে আসেন, আবার ভক্ত-অনুসারী জুটতে থাকে। মৃত্যুর পর তার কবর এমনভাবে নির্মাণ করা হয় যা অনেকের কাছে বিতর্কিত হয়ে ওঠে। মাটি থেকে উঁচু বেদি, বিশেষ রং ও প্রতীক—এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে স্থানীয় “ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি” ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করে। ধর্মীয় অনুভূতি, কুসংস্কার ও গুজবের মিশ্রণে পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
প্রশাসন চেষ্টা করেছিল বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করতে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বৈঠক হয়, উভয়পক্ষকে আলোচনায় বসানো হয়। নুরুল হকের পরিবার জানায়, তার ওসিয়ত অনুযায়ী দাফন করা হয়েছে, কবরের উচ্চতা তিন-চার ফুটের বেশি নয়। কিন্তু গুজব ছড়ানো হয় যে এটি ১২ ফুট উঁচু করা হয়েছে এবং কা’বার আদলে সাজানো হয়েছে। জনতার ক্ষোভ আর ধর্মীয় উত্তেজনা এমনভাবে বেড়ে যায় যে, যুক্তি বা আলোচনার কোনো মূল্য আর থাকেনি।
ঘটনার দিন শুক্রবার ছিল। জুমার নামাজের পর বিভিন্ন এলাকা থেকে তৌহিদী জনতা এসে শহীদ মহিউদ্দিন আনসার ক্লাবের সামনে জড়ো হয়। পূর্বঘোষণা ছিল, তাই লোকজন প্রস্তুতি নিয়ে আসে। হাতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ছিল, মুখে ধর্মরক্ষার স্লোগান। পুলিশ আগেভাগেই সেখানে উপস্থিত থাকলেও জনতার ঢল সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। দরবার শরীফ ও নুরুল হকের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়, আগুন দেওয়া হয়, প্রশাসনের গাড়ি পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, সেনাবাহিনী ও র্যাবকে নামাতে হয়।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। একদফা ধ্বংসযজ্ঞের পর দ্বিতীয় দফায় হামলা হয়। এবার তারা সরাসরি কবরের দিকে যায়। মরদেহ তোলা হয়, নিয়ে যাওয়া হয় মহাসড়কের মোড়ে। সবার চোখের সামনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয় সেই দেহ। এ যেন মধ্যযুগীয় বর্বরতার পুনরাবৃত্তি। ঘটনাস্থলে নিহত হন নুরুল হকের এক অনুসারী, আহত হন অন্তত পঞ্চাশজন। আহতদের মধ্যে সাধারণ মানুষ, পুলিশের সদস্য—অনেকে রয়েছেন।
প্রশ্ন জাগে—এই ঘটনার দায় কার? জনতার আবেগকে কে উসকে দিল? কেন প্রশাসনের আগাম পদক্ষেপ ব্যর্থ হলো? বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি মানুষের আবেগ অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সেই আবেগকে যদি কিছু গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, তবে তার পরিণতি ভয়াবহ হয়। নুরুল হক হয়তো নিজেকে ইমাম মাহাদি দাবি করেছিলেন, যা ইসলামী বিশ্বাসের পরিপন্থী। কিন্তু তার মৃত্যুর পর মরদেহ অবমাননা করা, কবর খুঁড়ে দেহ তুলে পুড়িয়ে দেওয়া—এটি ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামে মৃতদেহের সম্মান রক্ষা করা ফরজ, এমনকি শত্রুপক্ষের লাশও অবমাননা করা নিষিদ্ধ। অথচ ধর্মরক্ষার নামে এই নৃশংসতা চালানো হলো।
এ ঘটনার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটি অমানবিক, ঘৃণ্য ও আইনবিরোধী কাজ। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা হবে। প্রশ্ন হলো, এই প্রতিশ্রুতি কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হবে? কারণ অতীতে এমন অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাবের কারণে বিচার দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে যায়। ফলে জনগণের আস্থা নষ্ট হয়, আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
এখানে আমাদের সমাজের আরেকটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে—গুজব ও উগ্রতার সংস্কৃতি। যখন একটি গোষ্ঠী ঘোষণা দিল যে কবরটি শরীয়তবিরোধী, তখন অন্ধ আনুগত্যে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ল। তারা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করল না, প্রশাসনের সমাধান প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা রাখল না। ধর্মীয় উগ্রতার নামে সহিংসতা চালানো যেন বৈধ হয়ে গেল। অথচ ইসলাম শান্তির ধর্ম, যেখানে বলা হয়েছে “অন্যায়ভাবে কারও প্রাণ নেওয়া সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করার সমান।”
রাজবাড়ীর ঘটনাটি কেবল একটি স্থানীয় ইস্যু নয়, বরং পুরো দেশের জন্য সতর্কবার্তা। এখানে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়া উচিত।
প্রথমত, ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে রাজনীতি বা সামাজিক প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা রোধ করা জরুরি। একদল মানুষ যখন নিজেদের নেতা বানায়, তখন সহজেই জনমত উত্তেজিত করা যায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রশাসনের জন্য তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা। প্রশাসন আগেই জানত উত্তেজনা বাড়ছে। বৈঠকও হয়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন নেওয়া হলো না? কেন মানুষ আগেভাগে জমায়েত হতে পারল? কেন পুলিশের গাড়ি পর্যন্ত নিরাপদে রাখা গেল না? এসব প্রশ্নের উত্তর জনগণ জানতে চায়।
তৃতীয়ত, মানবাধিকার ও মৌলিক মূল্যবোধের অবমাননা। একটি লাশকে কবর থেকে তুলে এনে পুড়িয়ে দেওয়া সভ্য সমাজে অকল্পনীয়। এটি কেবল ধর্মীয় বা আইনি অপরাধ নয়, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এমন ঘটনা সমাজে ভয়, আতঙ্ক ও বিভাজন সৃষ্টি করে।
চতুর্থত, সামাজিক দায়িত্ব ও নাগরিক চেতনা। সাধারণ মানুষ কেন এমন ভিড়ে যোগ দেয়? কেন তারা উগ্র জনতার অংশ হয়ে ওঠে? এর পেছনে শিক্ষার অভাব, ধর্মীয় অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যা এবং সামাজিক নেতৃত্বের সংকট দায়ী। মানুষ যদি সঠিক শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা পেত, তবে এমন সহিংসতায় জড়িত হতো না।
এই ঘটনার ফলে রাজবাড়ীর সাধারণ মানুষের জীবনে আতঙ্ক নেমে এসেছে। দরবার শরীফের আশপাশের লোকজনের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেকেই আহত হয়ে হাসপাতালে। নিহত যুবকের পরিবার শোকাহত। অন্যদিকে, নুরুল হকের পরিবারও অপমানিত ও বিপর্যস্ত। সমাজে বিভেদ গভীর হয়েছে—একপক্ষ বলছে ধর্মরক্ষা করা হয়েছে, অন্যপক্ষ বলছে মানবতা পদদলিত হলো।
আমরা যদি সামগ্রিকভাবে দেখি, এই ঘটনা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সামাজিক সহনশীলতার জন্য এক বড় পরীক্ষা। সরকার যদি দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে না পারে, তবে এ ধরনের ঘটনা অন্য জায়গায়ও ঘটতে পারে। ধর্মের নামে সহিংসতা চালিয়ে কেউ যদি ছাড় পায়, তবে সমাজে অরাজকতা বৃদ্ধি পাবে। আবার, প্রশাসনের ব্যর্থতা যদি স্পষ্ট হয়, তবে জনগণের আস্থা ভেঙে পড়বে।
অতএব, এই ঘটনার সঠিক তদন্ত, দোষীদের চিহ্নিতকরণ এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি সমাজে ধর্মীয় সহনশীলতা, শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ জোরদার করতে হবে। মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ—সর্বত্র মানুষকে শেখাতে হবে, ভিন্নমত মানেই শত্রু নয়; ধর্মরক্ষার নামে নৃশংসতা কোনোভাবেই বৈধ নয়।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে যা ঘটল, তা কেবল একটি ব্যক্তিকে ঘিরে সহিংসতা নয়, বরং এটি আমাদের সমাজের অন্তর্লীন সমস্যার প্রতিফলন। কুসংস্কার, অশিক্ষা, আইন প্রয়োগে দুর্বলতা এবং উগ্রতার সংস্কৃতি মিলেই এই অমানবিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। আমাদের সামনে এখন দুটি পথ—আমরা কি এ ঘটনাকে শিক্ষা হিসেবে নিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করব, নাকি আবারও ভুলে গিয়ে নতুন সহিংসতার অপেক্ষা করব?
আজ রাজবাড়ীর মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষ হতবাক, বিবেকবানরা ক্ষুব্ধ। এই ক্ষত যদি দ্রুত নিরাময় না করা যায়, তবে তা জাতীয় জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। ধর্মীয় অনুভূতির নামে মানবতার বিপর্যয় রোধ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে—সরকার, নাগরিক সমাজ, ধর্মীয় নেতৃত্ব ও সাধারণ মানুষ।
কারণ শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি কেবল রাজবাড়ীর নয়—এটি বাংলাদেশের সভ্যতা, মানবতা ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন।
আপনার মতামত জানানঃ