২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে গণ–অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তা ছিল শুধু রাজনৈতিক নয়—একটি গভীর মানবিক বিপর্যয়ও। প্রথম আলো পত্রিকার অনুসন্ধানভিত্তিক প্রতিবেদন অনুসারে, এ অভ্যুত্থানে কমপক্ষে ১৩৩ শিশু শহীদ হয়েছে। এ সংখ্যা শুধু সংখ্যাগত নয়, বরং প্রতিটি শহীদের পেছনে রয়েছে একটি করুণ, হৃদয়বিদারক, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতায় মোড়ানো গল্প। তাদের কেউ স্কুলে যাচ্ছিল, কেউ মাদ্রাসায় পড়ত, আবার কেউ দরিদ্র পরিবারের হাল ধরে ক্ষুদ্র শ্রমজীবী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছিল।
শহীদদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল আব্দুল আহাদ, মাত্র চার বছর বয়সী, যিনি নিজ বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। আহাদের মৃত্যুর ঘটনায় বাবার যে হৃদয়বিদারক সাক্ষাৎকার উঠে এসেছে, তাতে বোঝা যায় এই রাষ্ট্রব্যবস্থার মানবিক অবক্ষয় কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। রায়েরবাগের এক বহুতল ভবনের ৮ম তলায় নিরাপদে খেলা করা শিশুটির চোখ ভেদ করে মাথায় গুলি ঢুকে যাওয়ার মতো নিষ্ঠুরতা কল্পনাকেও হার মানায়।
এই অভ্যুত্থানে শহীদ ১৩৩ শিশুর মধ্যে ৮৮ শতাংশ-এর মৃত্যু হয়েছে গুলিবিদ্ধ হয়ে। এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্র যেভাবে দমননীতি অবলম্বন করেছিল, তা ছিল নির্লজ্জ, মানবতাবিরোধী এবং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এদের মধ্যে ৯১ জন ছিল শিক্ষার্থী, বাকিরা দিনমজুর, হকার, দোকান কর্মচারী, পোশাক শ্রমিক ইত্যাদি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। যে সমাজে শিশুরা স্কুলে না গিয়ে খেটে খাচ্ছে, সেই সমাজ এমনিতেই বিপন্ন; তার ওপর গুলি চালিয়ে তাদের জীবনও কেড়ে নেওয়া শুধুই অমানবিক নয়, অপরাধ।
আরও যাদের মৃত্যু সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হল সাফকাত সামির (১০), নাঈমা সুলতানা (১৫), রিয়া গোপ (৬) ও ইমাম হাসান তায়িম (১৭)। এদের মধ্যে কেউ খেলছিল, কেউ কাপড় আনতে গিয়েছিল, কেউ বাবা–মায়ের সঙ্গে মিছিলে অংশ নিয়েছিল। এমনকি কেউ কেউ নিজের ইচ্ছায় আন্দোলনে নেমেছিল—শুধু তাদের ভেতরের প্রতিবাদের ভাষাকে প্রকাশ করতে। শাহারিয়ার খান আনাস যেমন মাকে একটি চিঠি লিখে আন্দোলনে যোগ দিয়ে বলেছিল, “মৃত্যুর ভয়ে ঘরে বসে নয়, সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ।” এই চিঠি আমাদের আজও কাঁদায়, কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের বিবেকের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলে, ৮৪৪ জন শহীদের তালিকা তৈরি করা হলেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরে তা কমিয়ে ৮৩৬ জনে নামিয়ে আনে। সেখানে কয়েকজনের নাম ছিল দু’বার, আবার কেউ সরাসরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই নাম বাদ দেওয়ার পেছনে কোনো গোপন উদ্দেশ্য ছিল কি? নাকি শহীদদের সংখ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাওয়ার একটি রাষ্ট্রীয় চেষ্টা?
প্রতিটি শিশুর মৃত্যু যে শুধু তাদের পরিবারকে ধ্বংস করেছে তা নয়, বরং একটি জাতির বিবেকেও রক্তের দাগ লেপে দিয়েছে। তায়িমের বাবার স্ট্রোক করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যাওয়া কিংবা রিয়া গোপের জন্মদিনেই তার মৃত্যুর ঘটনা—এইসব গল্প শুধু গণমাধ্যমের প্রতিবেদন নয়, বরং একটি প্রজন্মের ওপর চেপে বসা রক্তাক্ত স্মৃতি।
এই শিশুদের হত্যাকাণ্ডের পেছনে গুলি চালানোর নির্দেশ যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছিল, সেই অভিযোগ বারবার এসেছে শহীদদের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে। একাধিক ভিডিও, প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎকার এবং ঘটনার ধারাবাহিকতা—সব মিলিয়ে এই অভিযোগ পুরোপুরি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। রিজওয়ানুল ইসলাম, শহীদ আস সাবুরের বড় ভাই, বলেন, “ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমন করতে গুলি করার নির্দেশ শেখ হাসিনাই দিয়েছিলেন, এটি এখন নানাভাবে প্রমাণিত। আমরা চাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।”
জাতি হিসেবে এই শহীদ শিশুদের আমরা কী দিতে পেরেছি? শোকাবহ কবিতা? কয়েকটি কান্নাভেজা স্মারক? না কি কেবল সংখ্যার মধ্যে গিলে ফেলা হয়েছে তাদের জীবন ও স্বপ্ন? যখন কোনো রাষ্ট্র তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করে, তখন তা আর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়, বরং তা রূপ নেয় নিপীড়নপ্রবণ এক জিঘাংসার যন্ত্রে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ঠিকই বলেছেন—এটি ছিল গণহত্যা। নিজের দেশের শিশুদের হত্যা করে যে কলঙ্ক জাতি অর্জন করেছে, তা বহু প্রজন্ম ধরে বয়ে বেড়াতে হবে। একইসঙ্গে এই অভ্যুত্থান একটি গর্বের বিষয়ও—কারণ এই শিশুরাই প্রমাণ করেছে, অন্যায় ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বয়স লাগে না, লাগে শুধু সাহস আর বিবেক।
এখন সময় এসেছে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর। শহীদ শিশুদের নাম ধরে ধরে বিচার দাবি করতে হবে। যে সরকার শিশুদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, তাকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই হবে। তাহলেই অন্তত কিছুটা হলেও আমরা শহীদ আহাদ, রিয়া, তায়িম, সাবুর, আনাস ও তাদের মত অসংখ্য শহীদের আত্মাকে শান্তি দিতে পারব।
এ কলঙ্কিত অধ্যায় কখনো ভুলে যাওয়া যাবে না। আমাদের শুধু স্মরণ করলেই হবে না, লড়াই চালিয়ে যেতে হবে—যেন ভবিষ্যতে আর কোনো শিশু বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুলির শিকার না হয়, যেন আর কোনো বাবা সন্তানের রক্তে রাঙানো জামা বুকে চেপে কাঁদতে না বসে।
আপনার মতামত জানানঃ