দেশের ৯০ শতাংশ শিশু নিয়মিত বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্যি। ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইউনিসেফের যৌথ আয়োজনে একটি সম্মেলনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫ কোটি ৭০ লাখের কাছাকাছি শিশু রয়েছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। এর মধ্যে ১৪ বছরের নিচের প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিশু বাড়িতে নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হয়। অর্থাৎ প্রতি ১০টি শিশুর মধ্যে ৯টি শিশুই সহিংসতার শিকার। সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে সপ্তাহে ২০টি শিশু মারাও যায়।
ইইউ ও ইউনিসেফের তথ্যের বরাতে প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিশুদের সুরক্ষায় বাংলাদেশের অগ্রগতি হলেও সহিংসতা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে উদ্বেগজনকভাবে।
বাংলাদেশে ৩০ লাখের বেশি শিশু শিশুশ্রমের ফাঁদে আটকে আছে, যার মধ্যে ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে একটি শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করার আগেই শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়ে। প্রতি দুটি মেয়েশিশুর মধ্যে একটির বাল্যবিবাহ দেওয়া হয়। প্রায় অর্ধেক শিশুর জন্মনিবন্ধন নেই। এখনো লাখো শিশু রাস্তায় বসবাস করে।
প্রায় সব দেশেই (৮৮ শতাংশ) নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য আইন রয়েছে, তবে অর্ধেকের কম দেশগুলোতে (৪৭ শতাংশ) আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে অপরাধীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা হয়; যার কারণে শিশু নির্যাতন ঘটেই চলেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখিত এক হিসাবে, জরিপের আগের মাসে বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছরের শতকরা ৮৯ ভাগ শিশুকে ‘শৃঙ্খলা’ বা কোনো কিছু শেখানোর নামে নির্যাতন করা হয়েছে। শিশু সুরক্ষা নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে আমাদের দেশে শিশুদের শাস্তি বেশির ভাগ মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য। এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সচেতনতা খুব কম। সব শিশুই নির্যাতনের ঝুঁকিতে আছে, তবে শিশুশ্রমিক, পথে বসবাসকারী শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, প্রতিষ্ঠানে বসবাসকারী শিশুসহ অনেক শিশু তাদের অবস্থানের কারণে অতিরিক্ত ঝুঁকিতে থাকে।
শিশুরা ভয়ংকর নির্মমতার শিকার হলে মিডিয়ায় খবর হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সবাই ভুলে যাই। শুধু ভয়াবহ ঘটনাগুলো আমরা জানতে পারি। প্রতিদিন অসংখ্য শিশু ঘরে এবং বাইরে নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করছে। তাদের খবর কে রাখে?
বাংলাদেশে শিশু, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে যথাযথ সমন্বয়ের অভাব সামগ্রিকভাবে শিশুর নির্যাতন মোকাবিলাকে কঠিন করে তুলেছে। তার সঙ্গে রয়েছে অপর্যাপ্ত পেশাদারি দক্ষতা এবং সীমিত বিনিয়োগ।
বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩২ থেকে ৩৭ শতাংশ দেশ নির্যাতনের শিকার শিশুদের সেবা দেয়, এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। তবে বেশির ভাগ শিশুই থেকে যায় এর আওতার বাইরে। ২৬ শতাংশ দেশ মা–বাবা ও যত্নকারীদের সহায়তাবিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং ১৫ শতাংশ দেশ শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো প্রকল্প নেই।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শিশুদের জন্য সুরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে শিশু সুরক্ষায় পর্যাপ্ত আইন রয়েছে।
সে ক্ষেত্রে শিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে প্রচলিত আইনের বাস্তবায়ন ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এ ছাড়া শিশুর উন্নয়ন ও কল্যাণে বিনিয়োগ প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
বিভিন্ন বয়সী শিশুদের চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি আলাদা হয়। শিশু বিকাশের পর্যায়গুলো বুঝে তাদের বয়স উপযোগী ভালোবাসা এবং উষ্ণতা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষের দক্ষতা এবং আন্তরিকতার অভাব আছে। মনোযোগ দিয়ে শিশুদের কথা শোনা, কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলে তাদের বুঝিয়ে বলা যে গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিষয়ে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই।
আজকের শিশুই দেশের ভবিষ্যৎ—এ কথা মাথায় রাখতে হবে। শিশুর প্রতি সহিংসতা বা নির্যাতন সাময়িক কোনো বিষয় নয়, এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলও আছে। শিশুরা যদি সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে, সেটা যেমন দেশের জন্য মঙ্গলকর, তেমনি শিশুরা সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার হলে তা নানা রকম নেতিবাচক পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
একটা রাষ্ট্র-সমাজ কতটা মানবিক, কতটা সংবেদনশীল, তা অনেকটাই বোঝা যায় শিশুদের প্রতি আচার-আচরণ, বিবেচনাবোধ এবং গুরুত্ব প্রদানের বিষয়টি থেকে। আমরা যদি সত্যিই একটি মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে শিশুদের প্রতি সব ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/০৮৫৬
আপনার মতামত জানানঃ