সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত অতিবেগুনি তেজস্ক্রিয় রশ্মি পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। এই রশ্মি ওজোন গ্যাসের কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বা ওজোন গ্যাস তেজস্ক্রিয় রশ্মি শোষণ করে নেওয়ার ফলে ভূপৃষ্ঠের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় থাকে এবং ক্ষতিকর রোগ থেকে মানুষ মুক্তি পায়। বিশেষ করে সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মি ওজোন গ্যাস শোষণ করে নেওয়ায় ত্বকে ক্যানসার ও চোখের রোগ থেকে মুক্তি মেলে। সেই প্রকৃতির রক্ষাকবচ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ভূপৃষ্ঠে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারের কারণে ওজোনস্তর ক্ষয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি ওজোন স্তরে অ্যান্টার্কটিকার চেয়েও আকার-আয়তনে বড় বিশাল একটি ফাটল তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তরের ওপর নিয়মিত নজরদারির দায়িত্ব যাদের কাঁধে, সেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোপারনিকাস অ্যাটমসফিয়ার মনিটরিং সার্ভিস গত বুধবার এই খবর দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, এই মৌসুমে বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তরে এত বড় মাপের ফাটল খুবই অপ্রত্যাশিত। অত্যন্ত বিপজ্জনকও মানবসভ্যতার জন্য। ওজোনস্তরে এত বড় মাপের ফাটল শেষ দেখা যায় ৪২ বছর আগে, ১৯৭৯ সালে। খবর আনন্দবাজার
কোপারনিকাস অ্যাটমসফিয়ার মনিটরিং সার্ভিসের তরফে এ-ও জানানো হয়েছে, ওজোনস্তরের ওই ফাটল খুব দ্রুত বড় হচ্ছে। বাড়ছে আকার-আয়তনে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে নিচের স্তরকে (ভূপৃষ্ঠ ও তার কাছাকাছি) বলা হয় ‘ট্রপোসফিয়ার’। তার ওপরে রয়েছে আরেকটি স্তর। যার নাম ‘স্ট্র্যাটোসফিয়ার’। সেই স্ট্র্যাটোসফিয়ারের একেবারে ওপরের স্তরে আছে ওজোনের পুরু চাদর। নীলাভ গ্যাসের। ভূপৃষ্ঠের সাত থেকে ২৫ কিলোমিটার বা ১১ থেকে ৪০ কিলোমিটার উঁচুতে। এই ওজোনের পুরু চাদর অতিবেগুনি রশ্মি, সৌরকণা, মহাজাগতিক রশ্মিসহ নানা ধরনের মহাজাগতিক বিকিরণের হাত থেকে বাঁচায় যাবতীয় প্রাণ। কাজ করে ‘সানস্ক্রিন’-এর মতো।
কোপারনিকাস অ্যাটমসফিয়ার মনিটরিং সার্ভিসের কর্মকর্তা ভিনসেন্ট-হেনরি পিউচ বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে নিখুঁতভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে না বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের এই ফাটল আরো কতটা বড় হবে। আর সেটা আরো কতটা দ্রুত হারে হবে। তবে এটুকু বলা যায়, ১৯৭৯ সাল থেকে ওজনস্তরের এই ফাটলের আকার বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তাতে এই ফাটলকে গভীরতম বলাই যায়। এমনকি তা দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে। এই ফাটল আকারে-আয়তনে অ্যান্টার্কটিকার চেয়েও বড়।
আকাশের নিলাভ রঙ-ই হচ্ছে ওজোন স্তরের রং৷ ওজোন অক্সিজেনের একটি রূপভেদ৷ যার রাসায়নিক সংকেত হচ্ছে তিনটি অক্সিজেন পরমাণুর একত্রিকরণ৷ সূর্যের ‘অতিবেগুনি রশ্মি’ এই ওজোন স্তর শোষণ করে নেয়, যার জন্য সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব থেকে পৃথিবীর প্রাণীসহ উদ্ভিদজগতের বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে৷
পৃথিবীর পরিবেশ ক্রমেই চরমভাবাপন্ন হচ্ছে, তাপমাত্রা যাচ্ছে বেড়ে, বাড়ছে পরিবেশগত অসামঞ্জস্য অবস্থা৷ আর এই অসামঞ্জস্যের অন্যতম প্রধান কারণ পৃথিবীকে ঘিরে থাকা ওজোনস্তরের ক্ষয় এবং এর মধ্যে ফাটলের সৃষ্টি৷
আজ থেকে ২৫ বছর আগে এক দল আবহাওয়া বিজ্ঞানী যখন অ্যান্টার্কটিকায় গবেষণা চালাচ্ছিলেন, তখনই তাদের সুক্ষ্ণ আকাশ পর্যবেক্ষক যন্ত্রে ভেসে ওঠে এক ফুটো৷ যার আকার দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে৷ আর এর মাধ্যমেই সূর্যের ‘অতিবেগুনি রশ্মি’ এসে পৌঁছাচ্ছে পৃথিবীতে৷ বিজ্ঞানীরা যখন তাদের এই আবিস্কারের কথা প্রকাশ করলেন, তখন থেকে সারা বিশ্বে এটি একটি প্রধান আলোচ্য বিষয়৷
১৯২০ সালের পর থেকে সিএফসিসহ কলকারখানার বিভিন্ন গ্যাসের কারণে পৃথিবীর পরিবেশগত প্রাকৃতিক ধারা বদলে যেতে থাকে৷ বিপর্যস্ত হতে থাকে পরিবেশ৷ যখন আমাদের টনক নড়ে তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল৷ এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা তৈরি হয় এবং ১৯৮৭ সালে সিএফসি ও অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের ব্যবহার-সংক্রান্ত মন্ট্রিল চুক্তি সম্পাদিত হয়৷ এরই ফলস্বরূপ বিজ্ঞানীরা দেখতে পান কিছুটা উন্নতি৷
কুমেরুর ওজোনস্তরে ক্ষয়ের সাম্প্রতিক কয়েক বছরের তথ্য সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে৷ এ সমস্যা মোকাবিলার জরুরি সমাধান খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা৷ ভয়াবহ এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই৷ ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে প্রতিটি দেশের সরকারকে৷ আর কাজটি করা যেহেতু কোনো একটি দেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এ জন্য দরকার সারা বিশ্বের ঐকমত্য৷ সে লক্ষ্যে নানা উপলক্ষে দফায় দফায় বিশ্বনেতারা বসছেন, প্রতিজ্ঞা আর চুক্তি করছেন৷ কিন্তু এর কতটুকু সত্যিকারের উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা, সে ব্যাপারে বিতর্ক আছে ঢের৷ আর এত কিছুর মধ্যেও বিজ্ঞানীরা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন সামনের ভয়াবহ দিনের কথা৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৪
আপনার মতামত জানানঃ