ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সন্ধিস্থলে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসের পাতা উল্টালে আপনি দেখতে পারবেন বিদ্রোহ, বীরত্ব, আধিপত্য আর বিশ্বাসঘাতকতার অজস্র চড়াই-উতরাই। এই অঞ্চলটি কূটকৌশলী নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়িক স্বার্থের কাছে সার্বভৌমত্ব হারালেও ইতিহাস তাদের বীরের মর্যাদা দিয়েছিল।
১৮২৫ সালের ২১ জুলাই ডাচদের বিরুদ্ধে ইয়োগিয়াকার্তা সালতানাতের তৃতীয় সুলতান তৃতীয় হামেংকুবুয়োনো’র সন্তান ও শাহজাদা দিপোনেগোরো সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দেন। বিদ্রোহ বিপ্লব আর ষড়যন্ত্রের এই যুদ্ধ সম্পর্কে জানার আগে, এই অঞ্চলে ডাচদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জানা যাক।
ষোল শতকের দিকে মসলা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ইউরোপে নৌ-শক্তি বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছিল। ইন্দোনেশিয়ায় ইউরোপীয় শক্তির আধিপত্য বিস্তারের শুরু ১৫১১ সালে। আলবুকার্ক মালাক্কা অঞ্চলে সুলতানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় পর্তুগীজ। এর বছর খানেক আগে এই আধিপত্যের ভীত গড়ে দেয় পর্তুগীজ নাবিক আফোন্সো দ্য আলবুকার্ক; দক্ষিণ পশ্চিম ভারতের গোয়া অঞ্চল দখল করেন তিনি।
পর্তুগীজদের পরেই এই অঞ্চলে ডাচ বা ওলন্দাজদের আগমন। পর্তুগীজদের চেয়ে আরও উন্নত নৌ-শক্তি, অস্ত্র, সাংগঠনিক ক্ষমতা, প্রযুক্তি ও বণিকবৃত্তি নিয়ে তারা ঘাঁটি স্থাপন করতে বেরিয়েছিল। ১৫৯৫ সালে ওলন্দাজ নাবিক কর্নেলিস দ্য হ্যটম্যান ইন্দোনেশিয়ার জাভা অঞ্চলে এক অভিযানের নেতৃত্ব দেন। এর দু বছর পর জাহাজ ভর্তি মসলা নেদারল্যান্ডসে পৌঁছায়।
১৫৯৮ সাল থেকে ইন্দোনেশিয়ায় শুরু হয় ওলন্দাজদের অভাবনীয় সফল মসলা বাণিজ্য। এরপর ১৬০২ সালে ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ গঠনের মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশিয়ার মাটিতে বিদেশী বণিক শক্তির ঘাঁটি কার্যত অনড়ভাবে গেড়ে বসে; আর শুরু হয় উপনিবেশ ও দাসত্বের যুগ।
এদিকে, মাতারম সালতানাত ছিল জাভার সমৃদ্ধ রাজ্যের এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। অষ্টাদশ শতকে এই সালতানাত বিভিন্ন ভাঙনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। মাতারম সুলতান আগাংয়ের পর রাজ্য কার্যত ভাঙনের দিকেই যাচ্ছিলো এবং অবশেষে এই ঐতিহ্যবাহী সালতানাত ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেলো। ১৭৫৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, যুবরাজ মাংকুবুমি ও সুলতান তৃতীয় পাকুবুয়োনো’র মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে রাজ্যটি ইয়োগিয়াকার্তা ও সুরাকার্তা নামে দু’টি ছোট রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়।
এর ফলে ব্যবসায়িক কোম্পানি শুল্কারোপ ও আদায়ের সুযোগ ছাড়াও, সালতানাতের সমান্তরাল ক্ষমতা ওলন্দাজদের হাতে চলে যায়। ফলে দরিদ্র কৃষক ও কারিগরের উপর অত্যাচার বেড়ে যায় কয়েকগুণ। স্থানীয় মানুষের স্বার্থ দেখার কোনো দায় না থাকায় কোম্পানি বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে ইয়োগিয়াকার্তা রাজ্যের নেতৃবৃন্দ ইউরোপীয় বণিকদের ওপর চটে ছিল।
শাহজাদা দিপোনেগোরো বড় হয়েছেন নিজের জন্মভূমিতে ১৮১০ সালে ইংরেজ ও ওলন্দাজ শক্তির মধ্যে জাভার দখলের লড়াই দেখে। এছাড়া সালতানাতের ক্রমাগত অক্ষম হয়ে পড়া দেখে তিনি দেশকে বাঁচানোর উপায় খুঁজছিলেন।
এর মধ্যে ১৮১২ সালে ইয়োগিয়াকার্তা সালতানাতকে রাজ্যের ব্যয়ভার ও বকেয়া শুল্ক পরিশোধের অজুহাতে কার্যত দু’ভাগে বিন্যস্ত করে দেওয়া হলো; যার মূলে ছিল দুই শত্রুভাবাপন্ন ইউরোপীয় বণিক শক্তির লড়াই। আর রাজ্যের প্রশাসনের তোয়াক্কা না করে দরিদ্র কৃষকদের উপর চাপানো হয়েছিলো করের বোঝা। এই অমানবিক অত্যাচার ও অজন্মার কারণে ১৮১৫ সালে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। পাশাপাশি বিউবোনিক প্লেগে জাভা অঞ্চলের অগণিত হতভাগ্য মানুষ প্রাণ হারালো।
ইয়োগিয়াকার্তা সালতানাত একপ্রকার ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছিল। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের খেয়াল খুশি মতো রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় স্থাপনা তৈরি করতে শুরু করে। শাহজাদা দিপোনেগোরো’র পিতা ও মাতার সমাধিস্থলের উপর দিয়েই ১৮২৪ সালে ওলন্দাজরা একটি দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এতে সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায় দিপোনেগোরোর। যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দিলে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিপোনেগোরোকে গ্রেফতার করার জন্য সৈন্য পাঠায়। এতে আরও তেতে ওঠে বিদ্রোহের আগুন। সেরালং এলাকা থেকে সেই আগুন পূর্ব ও মধ্য জাভার বিদ্রোহ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বাড়তে থাকে সাধারণ মানুষের সমর্থন। ইয়োগিয়াকার্তার ২৯ জন যুবরাজের মধ্যে ১৫ জন এবং অভিজাতদের ৮৮ জনের মধ্যে ৪১ জন দিপোনেগোরোকে সমর্থন জানায়; আর ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো তো তার পক্ষেই ছিল সবসময়।
সরাসরি যুদ্ধে ওলন্দাজদের বিরুদ্ধে পেরে ওঠা সম্ভব না জেনে, বিদ্রোহীরা গেরিলা যুদ্ধ করতে লাগল। ১৮২৬ সাল নাগাদ জাভার বিভিন্ন এলাকা থেকে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পিছু হটতে শুরু করে। কিন্তু কুচক্রি ওলন্দাজেরা ১৮২৭ সালে বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে শাহজাদা দিপেনোগোরো’র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। প্রাথমিক বিজয়ের পর বিদ্রোহীদের উদ্যোমেও ভাটা পড়েছিল। পাশাপাশি বিদ্রোহীদের দলে ম্যালেরিয়া মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮২৮ সাল থেকে ওলন্দাজ ও তাদের পক্ষের দলের শক্তি বাড়তে থাকলে বহু বিদ্রোহী গোষ্ঠী শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপরের বছর ১৮২৯ সালের নভেম্বরে দিপোনেগোরো’র চাচা মাংকুবুমি ও অক্টোবরে সেনাপতি আলী প্রাউইরাদির্জা আত্মসমর্পণ করেন। ১৮৩০ সালে পুরোপুরিভাবে ধূলিসাৎ হয় বিদ্রোহ।
এই বিদ্রোহে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রায় ৮ হাজার ইউরোপীয় সদস্য নিহত হয়। আর শাহজাদা দিপোনেগোরোর পক্ষের প্রায় ২ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। শাহজাদাকে সমঝোতার জন্য ডাচ দূর্গে আমন্ত্রণ জানালেও বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর নির্বাসন দেওয়ার পর ১৮৫৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে মৃত্যু শাহজাদা দিপোনেগোরোকে মারতে পারেনি। ইন্দোনেশিয়ায় আজও তিনি জাতীয় বীরের মর্যাদা পেয়ে থাকেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ