এবার সংরক্ষিত বন উজাড় করে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে বন বিভাগ। এ ধরনের বনে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা, এমনকি প্রবেশও নিষেধ। তবে ৯৮০ কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয়ে ওই সাফারি পার্ক নির্মিত হলে সেখান পর্যটকদের জন্য নানা অবকাঠামো, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, উপকেন্দ্রসহ ভারী অবকাঠামো নির্মিত হবে। আর সেখানে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ দর্শনার্থী আসবেন বলে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, বন বিভাগ লাঠিটিলা সাফারি পার্কের নাম প্রস্তাব করেছে মৌলভীবাজারের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক।
উন্নয়নের অংশ যখন বনভূমি ধ্বংস
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনভূমি লাঠিটিলা ওই জেলার একমাত্র সংরক্ষিত বন হিসেবে চিহ্নিত। লাঠিটিলা দেশের অন্যতম ক্রান্তীয় চিরসবুজ বন। সেখানে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে হাতি, উল্লুক, মায়া হরিণ, উল্টোলেজি বানর, আসামি বানর, মুখপোড়া হনুমান রয়েছে।
মৌলভীবাজারে এর আগে বর্শিঝোড়া ইকোপার্ক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক, মাধবকুণ্ড লেক, বাইক্কার বিলসহ বেশ কিছু পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। বছরে প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটক সেখানে যান। পর্যটকদের জন্য হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রাস্তাসহ নানা অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। এর ফলেই ওই বনভূমি ও জলাভূমিগুলোর জীববৈচিত্র্য হুমকিতে আছে বলে সরকারি-বেসরকারি নানা গবেষণায় উঠে এসেছে।
লাঠিটিলা বনভূমিটি সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করায় অপেক্ষাকৃত ভালো আছে। সেগুনগাছপ্রধান ওই বনভূমির ৫ হাজার ৬৩১ একরজুড়ে সাফারি পার্ক নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন এখানেও যদি সাফারি পার্ক করা হয়, তাহলে সেখান বনভূমি ও জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করছেন বন্য প্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। সাফারি পার্কে বন্য প্রাণী উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে। পর্যটকেরা নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ সাপেক্ষে ওই পার্ক পরিদর্শন করতে পারেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নির্বাচনী এলাকা বড়লেখা ও জুড়ী। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের ভাষ্য, মন্ত্রী তার নির্বাচনী এলাকায় বড় ধরনের উন্নয়নকাজ করার অংশ হিসেবে প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ওই সাফারি পার্কটি নির্মাণ করতে চাচ্ছেন। মন্ত্রী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।
বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসেন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি। তাতে আমাদের কাছে ওই এলাকাটি উপযুক্ত মনে হয়েছে। সাফারি পার্কের মূল অবকাঠামো হবে বেদখল হয়ে যাওয়া কৃষিজমিতে। আর মূল বনভূমি অক্ষতই থাকবে।
ভারসাম্য নষ্ট হবে বনের
মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর আসনের সাংসদ নেছার আহমদ মনে করেন, সাফারি পার্ক স্থাপনের জন্য লাঠিটিলার বন উপযুক্ত জায়গা নয়। কারণ, সেখানে সমৃদ্ধ বনভূমি ও বন্য প্রাণী আছে। আবার এর আশপাশে অনেকগুলো ত্রিপুরা পরিবার আছে। সাফারি পার্ক হলে ওই বনের অবশিষ্ট বন্য প্রাণীগুলো হারিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, এ ধরনের একটি বিশাল স্থাপনা একটি সংরক্ষিত বনের ভেতরে করা দেশের বিদ্যমান বন আইনের লঙ্ঘন।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সাফারি পার্কে ৫ হাজার ৬৩১ একরের মধ্যে ৮০০ একর এলাকায় ইকোভিলেজ, ৭০০ একর জঙ্গল সাফারি, ৩০০ একর কোর সাফারি হিসেবে গড়ে তোলা হবে। বাকি এলাকা বাঁশবন হিসেবে রয়ে যাবে। কোর সাফারি এলাকায় বাঘ, সিংহ, চিতা, হায়েনা, সরীসৃপ, গন্ডারসহ বিভিন্ন প্রাণীর জন্য আলাদা আলাদা সাফারি গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
ও প্রসঙ্গে বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খান বলেন, লাঠিটিলার মতো এত সমৃদ্ধ একটি বনভূমিতে সাফারি পার্ক স্থাপন করা হলে এখানকার সব বন্য প্রাণী তো পালিয়ে অন্যত্র যাবেই, একই সঙ্গে পর্যায়ক্রমে পুরো বনটি ধ্বংস হয়ে যাবে। কোনোভাবেই এখানে সাফারি পার্ক স্থাপন করা উচিত হবে না।
আর এমন একটি সমৃদ্ধ বনভূমি ভালোমতো সংরক্ষণ করলেই সেখানে বন্য প্রাণীদের সংখ্যা প্রাকৃতিকভাবেই বাড়বে। সাফারি পার্ক স্থাপন করলে সেখানে যেসব বিদেশি বন্য প্রাণী আনা হবে, তাদের কারণে সেখানে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতাও দেখা দিতে পারে।
সম্ভাব্যতা যাচাই এবং নেতৃত্বের দূর্নীতি
এদিকে, সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সংরক্ষিত বনের ভেতরেই গড়ে ওঠা ৬টি গ্রামে ৩০৩টি পরিবারের মোট ১ হাজার ৭০৪ জন মানুষ বসবাস করে। বেশির ভাগ এলাকায় পাকা ঘর, সড়ক, বিদ্যুতের লাইনসহ নানা অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। বনভূমি কেটে পরিষ্কার করে সেখানে ফসলের চাষ হচ্ছে। সুপারিশ হিসেবে রূপছড়া ও লাঠিছড়া গ্রামের ৪২টি পরিবারকে বাকি ছয়টি গ্রামে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সূত্র মতে, বনের বিভিন্ন স্থানে লোকজন পাকা ঘর তুলেছেন। বিভিন্ন প্রজাতির লেবু, কমলা, কলা, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ধরনের ফলের বাগান করেছেন। অনেকে জলাশয়ে মাছেরও চাষ করেছেন। কয়েকটি স্থানে বন বিভাগের উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় করা সেগুনবাগান রয়েছে।
প্রকল্পটি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সমীক্ষাটি করেছে বেটস কনসালটিং সার্ভিসেস। সমীক্ষাটির নেতৃত্ব দিয়েছেন বন বিভাগের প্রকৃতি সংরক্ষণ এবং বন্য প্রাণী অঞ্চলের সাবেক বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে। এর আগে তার নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালে কক্সবাজারের চকরিয়ায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক ও ২০১২ সালে গাজীপুরে বঙ্গবন্ধুর নামে আরেকটি সাফারি পার্ক নির্মিত হয়। দুটি সাফারি পার্ক নির্মাণেই প্রধান ভূমিকা রাখেন তপন কুমার।
গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক নির্মাণের সময় সরকারের অডিট বিভাগ দুর্নীতি ও নিম্নমানের কাজের অভিযোগ তুলেছিল। বন বিভাগ থেকে এ ব্যাপারে নিজস্ব তদন্ত হয়েছিল। প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে তপন কুমারের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ ওঠে।
২০১২ সালের ১২ জুন র্যাবের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত শ্যামলীর একটি বাসা থেকে বাঘের তিনটি বাচ্চা উদ্ধার করে। এর সঙ্গে জড়িত আসামি জাকির হোসেন আদালতে জানান, তপন কুমার (মহাখালী বন অফিসে বসে) তাদের কাছে লিখিত দিয়ে বাঘসহ বন্য প্রাণী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠাতেন। তবে তপন কুমার আদালতের কাছে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
২০০৮ সালে বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক ওসমান গনি বালিশের ভেতরে ৫০ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার হন। ওই সময় ওসমান গনির দুর্নীতির টাকা সংগ্রহের সহযোগী হিসেবে তপন কুমারের নাম আসে। তাকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হয়ে কয়েক মাস কারাবাস করতে হয়। এরপর তিনি পুনরায় চাকরিতে বহাল হন।
অভিযোগের বিষয়ে তপন কুমার দে বলেন, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আগের অভিযোগ ও মামলাগুলো করা হয়েছিল। আর এই লাঠিটিলা বনকে দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে সাফারি পার্ক স্থাপন বেশ কার্যকর উপায়। এর আগে গাজীপুরে সাফারি পার্ক স্থাপনের পর দখলদার কমেছে ও বন্য প্রাণী বেড়েছে।
কিছু প্রশ্ন
প্রতিবেদনটিতে সাফারি পার্ককে বন রক্ষার মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দুই মাসের জরিপের মাধ্যমে বনটির গাছপালা ও প্রাণির তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কীভাবে এতো অল্প সময়ে একটি বনের বৈজ্ঞানিক তালিকা তৈরি করা সম্ভব?
পরিকল্পনায় সিংহ, হায়েনা, চিতার মতো আফ্রিকান মাংশাসী প্রাণি, এমনকি দক্ষিণ আমেরিকান জাগুয়ারকে এই বনে নিয়ে আসার কথা রয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিপন্ন গণ্ডার, অরিক্স, সাবেল হরিণ, জিরাফ, জলহস্তী, নু-হরিণ বা উইল্ডবিস্টের মতো প্রাণিও আনা হতে পারে সাফারি পার্কে। এতো ছোট জায়গায় (২০ বর্গ কি.মি) কীভাবে এতো বিস্তৃত প্রজাতির বন্যপ্রাণী বাস করবে?
সাফারি পার্কের ৫০০ কর্মকর্তার বাসস্থান নির্মাণসহ ভারি অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রাণিদের আবদ্ধ রাখার জন্য পরিবেষ্টনী দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বনের উপর এর প্রভাব কেমন হবে বলা হয়নি।
ডলফিন আর বেলুগা তিমি রাখার জন্য ডলফিনারিয়ামের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনায়। এটি রক্ষণাবেক্ষণের দক্ষতা আমাদের আছে কি?
সাফারি পার্ক নির্মাণ করার জন্য বিশাল অঙ্কের ৯৮০ কোটি টাকার বাজেট চাওয়া হয়েছে সরকারের কাছ থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জীব বৈচিত্র্যের হুমকির কারণে সাফারি পার্কটি সরকারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিপুল অঙ্কের বার্ষিক ক্ষতিও গুনতে হতে পারে। তাই এই বিশাল অঙ্কের অর্থ দেশের বিদ্যমান চিড়িয়াখানা ও পার্কগুলোতে বিনিয়োগ করা কি অধিক লাভজনক হতো না?
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ