দেশ যখন করোনা আর অসহ্য গরমে তটস্থ, বৃষ্টির জন্য মসজিদে মসজিদে প্রার্থনা করা হচ্ছে, তখনই রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কাটা হচ্ছে গাছ, করা হবে রেস্তোরাঁ। উদ্যানে মোট সাতটি খাবারের রেস্তোরাঁর কাজ তড়িঘড়ি করেই এগোচ্ছে। এ জন্য বেশ কিছু ছোট-বড় গাছসহ উদ্যানের বহু বছরের পুরোনা গাছগুলো শিকড়সহ উপড়ে ফেলে, করে দেয়া হচ্ছে বিক্রি। তবে রাষ্ট্রীয় গুরত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেআইপি) এলাকায় খাবারের রেস্টুরেন্ট নির্মাণ ও সেটা নির্মাণের জন্য গাছ কাটা যে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করবে না এটা ভাবেনি তারা। জনসাধারণের প্রশ্ন, উদ্যানের গাছ কেটে মাটি খুঁড়ে গর্ত করে রেস্টুরেন্ট নির্মাণ কি খুব বেশি প্রয়োজন?
কেটে ফেলা হচ্ছে অর্ধশতাব্দীর পুরনো গাছ
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্তোরাঁ নির্মাণের জন্য কেটে ফেলা হচ্ছে ৫০ বছরেরও বেশি পুরানো সব গাছ। রেস্তোরাঁর স্থাপনার পাশাপাশি ওয়াকওয়ে তৈরির জন্যও চলছে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি। এটি করতেও কাটা পড়ছে শতাধিক গাছ। উদ্যানের বিভিন্ন স্পটে পড়ে আছে বড় বড় গাছের গুঁড়ি। উদ্যানটিতে ঢুকলেই দেখা মেলে কাটার জন্য চিহ্নিত করা আকাশছোঁয়া সব গাছ।
গত ১০-১৫ দিনে গণপূর্ত অধিদফতরের আওতায় এখানকার প্রায় শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে বলে জানালেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তারা অভিযোগ করে বলেন, রাতারাতি গাড়ি নিয়ে এসে বড় বড় গাছগুলো কেটে উদ্যান উজাড় করা হচ্ছে।
গাছগুলো সেভ না করে রেস্টুরেন্টের জায়গা ম্যাপিং করা হয়েছে ফলে গাছগুলো কাটা পড়ছে বলেও জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণপূর্ত বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, উদ্যানে ঘুরতে আসা সাধারণ মানুষের খাবারের চাহিদা মেটাতে সাতটি রেস্টুরেন্ট নির্মাণের কাজ চলছে। এগুলো নির্মাণ করতে গিয়ে কিছুসংখ্যক গাছ কাটা পড়ছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
পাখিরা আশ্রয় হারাবে, বাড়বে তাপমাত্রা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এই উদ্যানে রোজ যাতায়াত শিক্ষার্থীদের। এরই মধ্যে গাছ নিধনের বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ করেছেন একদল শিক্ষার্থী। কাটা গাছের স্থানে বানিয়েছেন প্রতীকী পাখির বাসা।
এদিকে প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষার দাবিতে শিল্প তৎপরতা চালিয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠন বনোফুল। তারা বলেন, উদ্যান পাখিদের বসতি এভাবে গাছ কেটে নিলে শহরের পাখিরা আশ্রয় হারাবে। গাছ কাটা বন্ধ করুন।
আবহাওয়াবিদরা মনে করেন, গাছ কমে গেলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। বৃষ্টি কম হবে আর এতে প্রাণীকূল দুর্ভোগে পড়বে। তাই গাছ না কেটে গাছ রোপণ বৃদ্ধি করতে হবে।
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্টুরেন্ট স্থাপনের নামে নির্বিচারে গাছ কেটে সবুজ উদ্যানকে অক্সিজেন শূন্য করার প্রতিবাদ জানিয়েছেন পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চও।
বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, অনেক গাছের মধ্যে লাল চিহ্ন দেওয়া হয়েছে যেগুলো কাটা হবে। পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি আমির হাসান মাসুদ বলেন, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেআইপি) এলাকায় খাবারের রেস্টুরেন্ট নির্মাণ ও সেটা নির্মাণের জন্য গাছ কেটে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি ধ্বংস করা কতটা যৌক্তিক?
“গাছ নিধনের ফলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে এবং বাস্তুসংস্থান ভেঙ্গে পড়ছে। এমনিতেই ঢাকায় যত গাছ থাকার কথা, আছে এর চেয়ে অনেক কম। ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে বৃক্ষের শীতল ছায়া এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে নগরের তাপমাত্রা।”
পরিবেশবাদীরা কই?
উপড়ে পড়ে আছে অসংখ্য গাছ। অর্ধশত বছরের পুরনো গাছ কেটে তৈরি হচ্ছে রেস্তোরাঁ। পরিবেশবাদীদের চোখে পড়ছে না এসব? তারা কই?
যে সময় অসহ্য গরমে তটস্থ রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষ। পুরো বিশ্বই জলবায়ু বিপর্যয় কাটাতে কাজ করে যাচ্ছে। বৃষ্টির অভাবে ক্ষতি হচ্ছে ফসলের। মসজিদে মসজিদে বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়া হচ্ছে। আর এদিকে রেস্তোরাঁ তৈরির নামে সাফ করা হচ্ছে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।
এমনিতে পরিবেশবাদীদের বেশ সোচ্চার দেখা যায়। কোথাও কোনো গাছ কাটা হলে ছুটে যান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা কই, এখন তারা নীরব কেন? কী কারণ তাদের এই নীরবতার!
গাছ কাটা বন্ধে পবার ৬ সুপারিশ
গত মঙ্গলবার (৪ মে) ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অযথা রেস্টুরেন্ট নির্মাণ ও নির্বিচারে গাছ নিধন বন্ধ করাসহ ৬ দফা সুপারিশ জানিয়েছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।
অন্য সুপারিশগুলো হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিবেশ, তত্ত্বাবধান, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, দৈনন্দিন পরিচালনা বিশ্বমানের করতে হবে। রমনা গ্রিন ধরে রাখতে হবে।
জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে উদ্যানের জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক ভারসাম্য যেন নষ্ট না হয় এর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। উদ্যানের স্থান ও পরিবেশ সংরক্ষণ করতে একটি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে হবে।
উদ্যানে রেস্তোরাঁ, ওয়াকওয়ে কিংবা এ জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে অবিলম্বে জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে এবং উদ্যানসহ সব ঐতিহাসিক স্থাপনা বা এলাকার উন্নয়নের জন্য নগর পরিকল্পক, স্থপতি, শিল্পী, ইতিহাসবিদ, উদ্যানবিদ, প্রকৌশলী, শিক্ষক, পরিবেশবিদ ও কবি-সাহিত্যিক সব স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করতে হবে। যারা পরিকল্পনা থেকে শুরু করে উন্নয়ন কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন ও প্রয়োজনীয় মতামত দেবেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪১৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ