নদী-খাল আর বৃক্ষরাজিতে শোভিত অপরূপা ঢাকা এখন বিবর্ণ এক কংক্রিটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। নগর উন্নয়নের প্রভাবে দিনের পর দিন ঢাকা শহর থেকে কমে যাচ্ছে গাছ। এর প্রভাব পড়ছে নগরবাসীর জীবনযাপন ও স্বাস্থ্যে। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
যতটুকু সবুজ অবশিষ্ট আছে, সেখানেও পাল্লা দিয়ে চলছে বৃক্ষনিধন। অন্যদিকে এখনো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যেসব গাছ মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে, কর্তৃপক্ষের অযত্ন আর অবহেলায় তাও ভেঙে পড়ছে সামান্য বাতাসে। আবার মরেও যাচ্ছে। কংক্রিটের উন্নয়নে শহর পরিণত হচ্ছে ধুলোমাখা এক জঞ্জালে।
সরকারি হিসাবে ঢাকার দুই সিটি নিয়ে পুরো শহরের আয়তন প্রায় ৩০৬ বর্গ কিলোমিটার, যা আগে ছিল প্রায় ১৩০ বর্গ কিলোমিটার। সর্বশেষ জনশুমারি (২০২২) অনুযায়ী, এই দুই সিটিতে মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরে ৫৯ লাখ ৭৯ হাজার ৫৩৭ জন এবং দক্ষিণে ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪৫ জন। ঢাকা উত্তরে জনসংখ্যা বেশি হলেও দক্ষিণে ঘনবসতি সবচেয়ে বেশি, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৩৯ হাজার ৩৫৩ জন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০১৯ সালের এক গবেষণা বলছে, ঢাকায় সবুজ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট আয়তনের ৯ দশমিক ২ শতাংশ। গাছপালা থাকা এলাকার হিসাব করলে এটি আরও অনেক কম হবে। শহরটির মোট আয়তনের মধ্যে ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশই কংক্রিট আচ্ছাদিত। বাকি এলাকার মধ্যে ৯ দশমিক ২ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদিত, ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান এবং ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ জলাভূমি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ১৯৯৯ সালে ঢাকার সবুজ এলাকার পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৯৭ বর্গ কিলোমিটার; যা ২০১৯ সালে এসে ১২ দশমিক ৩৩ বর্গ কিলোমিটার হয়েছে। তবে সার্বিবভাবে গত ২০ বছরে এই সবুজ এলাকা হ্রাস পেয়েছে ৩৭ শতাংশ। ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা সবুজ রূপ হারাতে থাকায় নগরবাসীর জন্য পরোক্ষভাবে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
১৯৯৫ সালে ঢাকায় সবুজ অঞ্চল ছিল ১২ শতাংশ। আর সম্প্রতি তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশে। তবে শুধু গাছের হিসাব করলে সেটি আরও কম। বছর বছর সেই পরিমাণও কেবল কমছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। তবে সরকারের তথ্য মতে দেশে মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। রাজধানীর চিত্র আরও করুণ। ১৯৯৫ সালে ঢাকায় সবুজ অঞ্চল ছিল ১২ শতাংশ। আর সম্প্রতি তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশে। তবে শুধু গাছের হিসাব করলে সেটি আরও কম। বছর বছর সেই পরিমাণও কেবল কমছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েক বছর আগে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে ঢাকা শহরের সবুজ নিয়ে। এমনকি মান অনুযায়ী নগরীর সবুজ বিষয়টি নির্ধারণ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, নগরীতে সবুজ অঞ্চল থাকতে হয় জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৯ বর্গমিটার। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে রয়েছে মাত্র ৬ বর্গমিটার। তাও রয়েছে মাত্র ৬টি ওয়ার্ডে। অর্থাৎ ৯০ শতাংশের বেশি ওয়ার্ডে প্রয়োজনীয় সবুজ অঞ্চল নেই। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) মতে, ঢাকায় সবুজের পরিমাণ শহরটির মোট আয়তনের ৯ দশমিক ২ শতাংশ।
যেসব কারণে সবুজ রূপ হারাচ্ছে ঢাকা, তার মধ্যে অন্যতম, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ইমারত ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে সবুজের ওপর গুরুত্বহীনতা, কংক্রিটের পরিমাণ বৃদ্ধি, উন্মুক্ত স্থান ও জলাভূমি ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন এবং প্রাকৃতিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি। এ ছাড়াও নগরবাসীর সীমাহীন লোভ ও কংক্রিটের শোভা বর্ধনের কারণেও সবুজ ঢাকা ক্রমেই ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, বৃক্ষনিধনের পাশাপাশি রাজধানীতে যে পরিমাণ গাছ রয়েছে তাও বিভিন্ন সময় ভেঙে পড়ছে। গত কয়েক বছর ধরে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে রাজধানীজুড়েই। গত চার বছরে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ই ১৫টির বেশি গাছ উপড়ে পড়েছে।
উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের ভাষ্য, মাটির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ দেশীয় গাছ কেটে বিদেশি গাছ লাগানো, নানা সেবামূলক কাজের (ইউটিলিটি সার্ভিস) জন্য গাছের মূল কাটা পড়া, বয়সের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া, চারা উৎপাদন ও রোপণের সময় পলিথিনের ব্যবহার, গাছের যথাযথ পরিচর্যা না করা ইত্যাদি কারণে গাছ উপড়ে পড়ছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, এসব কারণে এক সময়ের গাছপালায় ঘেরা ও সবুজে আচ্ছাদিত ঢাকার বিমল বায়ু পরিণত হচ্ছে দূষিত বায়ুতে। যা এই শহরকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে প্রতিনিয়ত। ঢাকার দুই সিটিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এদিকে নজর দেওয়া জরুরি। না হয় পরিস্থিতি আগামীতে আরও খারাপ হবে।
তারা বলেন, ‘জনসংখ্যা বাড়ছে, সেই অনুপাতে সবুজ বাড়ছে না। উল্টো কমছে। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে। তাপমাত্রা বাড়ছে। জনজীবনে এর প্রভাব পড়ছে। সবুজ আচ্ছাদন সংরক্ষণ করতে হবে। অন্যথায় নগরবাসীর জন্য ঝুঁকি বাড়বে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ