মুজিব রহমান :: গণতন্ত্রের একটা মূল কথা হচ্ছে- ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক করে দিতে হবে। অথচ অধিকাংশ মুসলমানের কাছে ধর্মই হচ্ছে তার রাষ্ট্র। তারা কোনভাবে আলাদা করার কথা ভাবতেও পারে না। অথচ ৫শত বছরেরও আগে ১৫১৭ সালে মার্টিন লুথার এমন উপলব্ধি থেকেই চার্চের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরম্ভ করেন। রাষ্ট্রের উপর চার্চের প্রভাবমুক্তির দাবি উঠে, দাবি উঠে খৃস্ট ধর্ম সংস্কারের। এই আন্দোলনের বস্তুজাগতিক পরিস্থিতি ধর্মসংস্কারকে প্রায় অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। এই আন্দোলনের ফসল হলো প্রটেস্টান্ট মতাবলম্বীদের উত্থান। পুরোহিত শ্রেণির পক্ষে টাকার বিনিময়ে পাপমুক্তির সনদ দেয়া বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ বুঝতে পারে, ব্যক্তি ও স্রষ্টার মধ্যে পুরোহিত শ্রেণির দালালির কোন প্রয়োজন নেই। বাইবেল আরাধনার মাধ্যমে মানুষ নিজেই স্রষ্টার সাথে সরাসরি যোগাযোগ তৈরি করতে পারে। যে সংকট খৃস্টানরা অতিক্রম করেছিল ৫শত বছর আগে, আর আমরা সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছি।
দ্বিতীয় সক্রেটিস কেউ হতে পারেন না, তেমনি হবেন না আরেকজন মার্টিন লুথারও। খুব উপলব্ধি হয়, আমাদের মুসলিমদের পীর/মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যদি অমন একজন মানুষ আসতেন তবে হয়তো জাগরণ ঘটতো আমাদেরও। কোথাও পড়েছিলাম- “তিতাস জানে না তিস্তার কথা, কংস জানে না কুমারের কথা। জানাজানি হয় তখনই যখন তারা এক মোহনায় মেশে”। আমাদের মার্টিন লুথার হয়তো ভাবতো না ওই মার্টিন লুথারের কথা কিন্তু একই মোহনায় পৌঁছতো অন্তত। টাকার বিনিময়ে ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে কোরানে ১৬ স্থানে বলা আছে। সেদিকে কারো ভ্রক্ষেপ নেই। কেউ আমাদের লোভ দেখাচ্ছে পুলসেরাত পার করে দিবে – এজন্য তাদের জাহাজ রেডি থাকবে আখেরাতের দিন। তাদের মুরিদরাই অনায়াসেই জাহাজে করে পার হয়ে যাবে। সেই লোভে পা দিয়ে হাজার হাজার মানুষ মুরিদ হয়ে তাদের অর্থ দান করছে। ওয়াজ করতে ভাড়া এনে একেকজন পারফর্মারকে দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। অথচ এই টাকা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে তিনি দোজখের আগুনই কিনে নিচ্ছেন।
টাকার বিনিময়ে ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে কোরানে ১৬ স্থানে বলা আছে। সেদিকে কারো ভ্রক্ষেপ নেই।
প্রতিটি মুসলিম দেশেই একই অবস্থা। প্রতিটি স্থানেই ধর্ম প্রভাববিস্তার করছে রাষ্ট্রের উপর। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে প্রাধান্য দেয়ায় প্রতিটি রাষ্ট্রেই ভীষণ নিপীড়নের মুখে পড়ছে সংখ্যালঘুরা। তারচেয়েও বড় সংকট তৈরি করেছে গণতন্ত্রের জন্য। পৃথিবীতে এমন একটি মুসলিম রাষ্ট্রও নেই যেখানে সুষ্ঠুধারার গণতন্ত্র রয়েছে। আরব দেশগুলোর মানুষ জানেই না গণতন্ত্রের সুফল কাকে বলে।আমরাও চারবার পছন্দের দলকে নির্বাচিত করেছি মাত্র কিন্তু তারাও ক্ষমতায় গিয়ে আর গণতান্ত্রিক থাকেনি। তারা ভিন্নমত ও বিরোধীমতকে মারাত্মকভাবেই দমন করেছে। খোদ সৌদী আরবে সামান্য ছাড় দিলেও নাগরিকগণ জানেই না মানবাধিকার কি? নারী স্বাধীনতা কাকে বলে? ওখানে আইন করেই বন্ধ করা আছে রাজতন্ত্রের সমালোচনা। আমাদের আইন করে বন্ধ করা না হলেও, সরকারের সমালোচনাকেই ধরা হয় রাষ্ট্রবিরোধীতা হিসেবে। ফলে একই অবস্থা বিরাজমান সব মুসলিম দেশেই।
ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করতে না পারলে জনগণও নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে শিখবে না। তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা জাগ্রত না হয়ে অলৌকিক বিশ্বাসই প্রধান হয়ে দেখা দিবে। সরকারের অনাচারকে মেনে নিবে নিয়তি হিসেবে। ফলে সরকার বদলালেও অবস্থার পরিবর্তন হয় না। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা না করায় শিক্ষার উপরও পড়েছে এর মারাত্মক প্রভাব। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন বা বিসিএস ক্যাডার হিসেবে চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন বা নিদেন পক্ষে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হচ্ছেন তাদের কত শতাংশ আসছেন মাদ্রাসা থেকে? ছাত্রসংখ্যার অনুপাত থেকে যদি এই সংখ্যা খুবই নগণ্য হয় তবে আমাদের বুঝতে হবে সেখানে শিক্ষার মানের অধিক ঘাটতি রয়েছে। বাস্তবিকও তাই- আমরা স্বীকার করি বা না করি। একটি মাদ্রাসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করে নিজেও বুঝেছি। ধর্মও রাষ্ট্র পৃথক থাকলে, রাষ্ট্র জনগণকে সমদৃষ্টিতে দেখেই তাদের উন্নত করার চিন্তা করতো। উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে চীন খুবই মাথা ঘামাচ্ছে ওই কারণেই। ওখানে রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্ম নেই। পশ্চিমা বিশ্ব মুসলিমদের উস্কানি দিচ্ছে, উইঘুরের দিকে আঙুল তুলে।
উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে চীন খুবই মাথা ঘামাচ্ছে ওই কারণেই। ওখানে রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্ম নেই। পশ্চিমা বিশ্ব মুসলিমদের উস্কানি দিচ্ছে, উইঘুরের দিকে আঙুল তুলে।
এই যে হেফাজতের উত্থান এবং তাদের সাথে সমঝোতা বা তাদের তাণ্ডব বা তাদের প্রভাব আমরা দেখছি ওই একই কারণে। এখানে প্রতিটি ধর্মভিত্তিক দলই সুবিধা নেয় সরকারের কাছ থেকে। এমনকি সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় সংগঠনও অর্থ নেয়। এমনকি পূজার সময় তারা অর্থও নিচ্ছে সরকারের কাছ থেকে। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গাটা থাকার কথা ব্যক্তিগত পর্যায়ে। অথচ সেটাই ঢুকে পড়েছে রাষ্ট্রের অলিতে-গলিতে। আমরাও সংকট থেকে মুক্তি পাচ্ছি না, পাবোও না অদূরে।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ