আইনের ভাষায় একটা কথা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত আছে, প্রয়োজনে দশজন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক তবুও যেন একজন নিরপরাধীর সাজা না হয়। বিশ্বের সমস্ত বিচার ব্যবস্থায় এই কথাটি মোটা অক্ষরে স্মরণে রাখা হয়। নিরপরাধীর সাজা যেন না হয় সেজন্য সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। তারিখের পর তারিখ, বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ যাচাই বাছাই শেষে আদালত এইজন্যই বিচারের রায় প্রদান করে থাকেন যাতে ফাঁক-ফোঁকরে কোনো নিরপরাধীর সাজা না হয়ে যায়। বাংলাদেশেও এই রীতি রয়েছে। তবুও কোথায় কার যেন ভুলে কীভাবে যেন নিরপরাধীর সাজা হয়ে যায়। এসংখ্যাটা দেশে নেহাত কম নয়। প্রায়ই শোনা যায় কর্তৃপক্ষের ভুলে অপরাধ না করেও গ্রেপ্তার হন নিরীহরা। সম্প্রতি তেমনি এক ঘটনা ঘটেছে।
মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামি ‘মানিক মিয়া’-এর পরিবর্তে মাছ ব্যবসায়ী ‘মানিক হাওলাদার’-কে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শুধু নামের সঙ্গে মিল থাকায় মো. মানিকের মিয়ার স্থলে জেল খাটছেন শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জের মানিক হাওলাদার।
এদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মানিক মিয়ার বদলে মানিক হাওলাদারের কারাভোগের অভিযোগের বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করতে শরীয়তপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে এই অনুসন্ধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ৩০ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দিতে হবে। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আজ সোমবার(০৮ মার্চ) রুলসহ এই আদেশ দেন। সিরাজগঞ্জের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ ও জেল সুপারকে এই অনুসন্ধানকাজে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে।
নাম-পরিচয়ের সত্যতা যাচাই ছাড়া এই মামলায় মানিক হাওলাদারকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর আদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। স্বরাষ্ট্রসচিব, আইনসচিব, সিরাজগঞ্জের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক, সিরাজগঞ্জ জেলা কারাগারের জেলারসহ বিবাদীদের এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী পার্থ সারথী রায়। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর একটি মাদক মামলার চার বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মো. মানিক মিয়া, বাবা নজরুল হাওলাদার, গ্রাম ব্যাপারী কান্দির নামে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর সখিপুর থানায় আসে। আর সখিপুর থানার পুলিশ গত বছর ২৮ নভেম্বর ওই থানার আলম চাঁন ব্যাপারী কান্দি গ্রামের মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে মানিক হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। তিনি বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা কারাগারে রয়েছেন। আর দণ্ডপ্রাপ্ত মো. মানিক মিয়া এখনো পলাতক রয়েছেন।
মামলার এজাহার, রায় ও থানা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২ জুন র্যাব অভিযান চালিয়ে সিরাজগঞ্জের একটি এলাকা থেকে ফেনসিডিলসহ চার ব্যক্তিকে আটক করে। র্যাবের পক্ষ থেকে ওই দিন সলংগা থানায় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে চার ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়।
মামলার একজন আসামি শরীয়তপুরের ব্যাপারী কান্দি গ্রামের মানিক মিয়া। তার বাবার নাম ইব্রাহীম মৃধা। কিন্তু আটক হওয়ার পর তার বাবার নাম পাল্টে নজরুল হাওলাদার পরিচয় দেন। সলংগা থানার পুলিশ মানিকের দেয়া নাম ঠিকানার ওপর ভিত্তি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে।
সিরাজগঞ্জ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ওই চার আসামিকে চার বছর করে কারাদণ্ড দেন। একই সঙ্গে মো. মানিক মিয়া পলাতক থাকায় তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন আদালত।
অন্যদিকে, ওই মাদক মামলায় মানিক মিয়ার বদলে মানিক হাওলাদারকে গ্রেপ্তারের পর তার পরিবার ৩০ নভেম্বর শরীয়তপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিনের আবেদন করেন। একই সঙ্গে তিনি প্রকৃত আসামি নন তার স্বপক্ষেও কাগজপত্র উপস্থাপন করা হয়। তখন আদালতের বিচারক সখিপুর থানার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তালিম করা সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শামসুর রহমানকে আদালতে উপস্থিত হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করার নির্দেশ দেন।
৯ ডিসেম্বর এএসআই শামসুর রহমান আদালতে উপস্থিত হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। তিনি দাবি করেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় আসামি হিসেবে লেখা নামের সঙ্গ মিলে যাওয়ায় এবং এই নামে অন্য কোনো ব্যক্তি না থাকায় তিনি মানিক হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করেছেন। ২০০৯ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর সিরাজগঞ্জ জেলা কারাগারে তার যে আসামির ছবি সংরক্ষিত আছে তার সঙ্গে বর্তমানে কারাবন্দি ব্যক্তিকে মিলিয়ে দেখার অনুরোধ জানান এই পুলিশ সদস্য। এরপর আদালতের নির্দেশে শরীয়তপুর কারাগার থেকে মানিক হাওলাদারকে সিরাজগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয়।
মাদক দ্রব্য আইনের মামলায় চার বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত মো. মানিক মিয়ার পরিবর্তে বর্তমানে কারাগারে থাকা মানিক হাওলাদারের মুক্তি চেয়ে তার স্ত্রী সালমা বেগম গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আবেদন করেন। সালমার আবেদনে মানিককে সশরীরে আদালতে হাজির করা, তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া এবং এ ঘটনায় মানিক হাওলাদারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
গত বুধবার (৩ মার্চ) বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ শুনানি শেষে গতকাল ৭ মার্চ এ বিষয়ে শুনানির জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করেন।
আইনজীবী পার্থ সারথী রায় বলেন, আদালত প্রকৃত আসামিকে চিহ্নিত করতে শরীয়তপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে বিচারিক তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ৩০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আগামী ১২ এপ্রিল পরবর্তী আদেশের জন্য তারিখ রেখেছেন আদালত।
কয়েকদিন আগেও নারায়ণগঞ্জে নামের বিভ্রান্তিতে জামাল হোসেন নামের আসামির বদলে কামাল হোসেনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগে জানা যায়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় লেখা জামাল হোসেন। এতে ওভাররাইটিং করে কামাল হোসেন লেখা হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জ সদর থানা পুলিশের একটি টিম সৈয়দপুর পশ্চিম এলাকার মৃত সুরুজ মিয়ার ছেলে ও সৈয়দপুর বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সদস্য কামাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। গত বুধবার (৩ মার্চ) সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিযোগ করে ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, গাঁজা উদ্ধারের যে ঘটনায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সে ঘটনার সময়ে আমি দক্ষিণ কোরিয়া ছিলাম।
এর আগে মাদক মামলায় বিনা দোষে ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত শাহাবুদ্দিন বিহারীর পরিবর্তে আসামি হিসেবে প্রায় ৫ বছর ধরে কারাগারে ছিলেন রাজধানীর পল্লবীর বেনারসী কারিগর মো. আরমান বিহারী। শুধু আসামির বাবার নামের সঙ্গে আরমানের বাবার নামের মিল থাকায় আরমানকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
এমন উদাহরণ আরও রয়েছে। এদেশে এই সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে নিরপরাধীর সাজাভোগের উদাহরণ খুঁজে দেখলে দেখা যাবে প্রকৃত আসামির সংখ্যার চেয়ে অতো একটা কম নয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, একটা মানুষের খুন হওয়ার ঘটনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, দ্রুততম সময়ে আসামির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। বছরের পর বছর কারাভোগের পর কেউ খালাস পেলেও তাকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তার যৌবন কাটে কারাগারে। বৃদ্ধ বয়সে কর্মক্ষমতা থাকে না। ফলে পরিবারেও তিনি অবজ্ঞার পাত্র হন। তারা মনে করেন, স্পর্শকাতর মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অনেক দেশেই সময় নির্দিষ্ট থাকে। আমাদের এখানে এমন কঠোর মনোভাব অনুসরণ করা গেলে বিচারের নামে অবিচার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব; বিশেষ করে হত্যা মামলার ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দেওয়া দরকার। এ সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র, সাক্ষ্যগ্রহণের পর বিচার শেষ করতে হবে। এরপর মামলাটি আপিলে গেলে তাও নির্দিষ্ট সময়ে নিষ্পত্তি করতে হবে। এতে মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হবে না।
তবে বিচারকদের সদিচ্ছার ঘাটতি আছে বলে মনে করেন না তারা। কিন্তু জনসংখ্যা, অপরাধ ও যে হারে মামলা বাড়ছে, সেই তুলনায় বিচারকসহ অন্যান্য অবকাঠমো বাড়ছে না। ফলে মামলার চাপ রয়ে গেছে এবং এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে বলে মনে করেন। তারা মনে করেন, মামলার গুরুত্ব এবং জঘন্যতম অপরাধী না হলে সেগুলো পৃথক করে দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে। আসামি দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলে এবং সদাচরণ করলে সরকার মুচলেকা নিয়ে তাদের প্যারোল দিতে পারে। তাহলে কারাগারে আসামির সঙ্গে দুর্ভোগও কমে আসবে। প্রয়োজনে মামলার চাপ ও ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ কমাতে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিশন করা যেতে পারে। তারা মনে করেন, বিচারের নামে তো অবিচার কারও কাম্য নয়। এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া দরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২৩
আপনার মতামত জানানঃ