ময়মনসিংহের নান্দাইলে ঘটা এক ধর্ষণের ঘটনায় তদন্তে গিয়ে পুলিশের এসআই মো. মনিরুল ইসলাম আসামিকে গ্রেপ্তার না করে তার পক্ষ নেয়। ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ধর্ষকের পক্ষ হয়ে ধর্ষিতা পরিবারকে স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করার বুদ্ধি ও পরামর্শ দেয়। এ কারণে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলামকে সাময়িক বরাখাস্ত করা হয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত এসআই মনিরুল ইসলাম নান্দাইল থানায় উপ-পরিদর্শক হিসাবে কর্তব্যরত ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে এসআই মনিরুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনে স্থানান্তর করা হয়।
ময়মনসিংহ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) শাহজাহান মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ধর্ষণের মতো ঘটনার বিষয়ে কোনো আইনি সহায়তা না দিয়ে উল্টো ধর্ষণের শিকার কিশোরির পরিবারকে মীমাংসার বুদ্ধি দেয়ায় ও বিবাদীদের পক্ষ নিয়ে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে চরম অবহেলা, অদক্ষতা গুরুতর অপরাধ তথা বিভাগীয় শৃঙ্খলার পরিপন্থির সামিল। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অবস্থায় উপ-পরিদর্শক মনিরুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ লাইনে স্থানান্তর করা হয়েছে।
জানা যায়, উপজেলার গাঙাইল ইউনিয়নের সুরাশ্রম গ্রামের দিনমজুরের কিশোরী কন্যা স্থানীয় একটি মাদরাসায় নবম শ্রেণিতে পড়ে। মাদরাসায় ও প্রাইভেটে যাওয়া-আসার পথে প্রায়ই কিশোরীকে উত্যক্ত করতো এলাকার ইজিবাইক চালক আবু ছাঈদের ছেলে মনির মিয়া (১৯)। ঘটনাটি নিয়ে বিচার চাইলেও কোনো ধরনের বিচার পায়নি কিশোরীর পরিবার। এ অবস্থায় গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে নয়টার দিকে কিশোরী তার বাবাকে পাশের বাড়ি থেকে ডেকে আনতে গেলে মনির তার পথরোধ করে।
ধর্ষণের শিকার কিশোরী জানায়, এ সময় মনির তাকে বিয়ের কথা বলে ধর্ষণ করে। কিশোরী চলে যেতে চাইলে তাকে ঝাপটে ধরে মনির। পরে কিশোরীর চিৎকারে লোকজন ছুটে এলে দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরদিন এলাকায় বিচার চাইলে স্থানীয় সালিশকারীরা সালিশে বসে ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বিয়ে সিদ্ধান্ত ছাড়াও আইনি পদক্ষেপ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সালিশের সিদ্ধান্ত কার্যকরী না হওয়ায় ছয়দিন পর কিশোরীর বাবা বাদী হয়ে গত মঙ্গলবার রাতে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব পান নান্দাইল থানার উপ-পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম। তিনি গত বুধবার ঘটনাস্থলে গিয়ে কিশোরীর কথা ছাড়াও স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য শোনেন। কিশোরীর বাবা জানান, তদন্ত শেষে তদন্তকর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম তাকে বলেন ঘটনার শতভাগ সত্যতা পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় মামলা হলে ধর্ষণের কোনো ধরনের আলামত পাওয়া যাবে না। যে কারণে ঘটনাটি মীমাংসা করার জন্য পরামর্শ দেন।
ভুক্তভোগী কিশোরীর মা বলেন, পুলিশ এসে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে। তদন্ত শেষে পুলিশ মোবাইল করে ঘটনাটি কাউকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মীমাংসা জন্য বলছেন।
মোবাইলে কাকে মীমাংসার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাকে মীমাংসা করার জন্য বলেনি। মোবাইলে হয়তো ওসি সাহেবকে না হলে চেয়ারম্যান সাহেবকে মীমাংসার জন্য বলছে।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে নুর আহম্মেদ বলেন, সরেজমিনে তদন্ত করে ধর্ষণের সত্যতা পাওয়া গেছে। তা ছাড়া যেহেতু দুই পক্ষই গরিব ও অসহায় তাই ঘটনাটি আজকের (বুধবার) মধ্যে মীমাংসা করার জন্য বলা হয়েছে। অন্যথায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তা ছাড়া চেয়ারম্যানও দায়িত্ব নিয়েছেন।
নান্দাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মিজানুর রহমান আকন্দ বলেন, সময় বেঁধে দেয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এ ঘটনায় মামলা নেয়ার জন্য ওই কিশোরীর পরিবারকে খবর দেয়া হয়েছে।
এ নিয়ে গত বুধবার সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে দৃষ্টি গোচর হয় ময়মনসিংহ পুলিশ সুপারের। পরে রাতেই মামলাটি এফআইআর ভুক্ত হলে বৃহস্পতিবার ধর্ষণের শিকার কিশোরীকে ডাক্তারি পরক্ষিার জন্য হাসপাতালে ও জবানবন্দির জন্য আদালতে পাঠানো হয়।
এর মধ্যে পুলিশ সুপার মোহা. আহমার উজ্জামান স্বাক্ষরিত এক আদেশে আসে নান্দাইল থানায়। যাতে লেখা আছে, ধর্ষণের মতো ঘটনার বিষয়ে কোনো আইনি সহায়তা না দিয়ে উল্টো ধর্ষণের শিকার কিশোরীর পরিবারকে মীমাংসার বুদ্ধি দেওয়ায় ও বিবাদীদের পক্ষ নিয়ে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে চরম অবহেলা, অদক্ষতা গুরুতর অপরাধ তথা বিভাগীয় শৃঙ্খলার পরিপন্থীর সামিল। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অবস্থায় উপ-পরিদর্শক মনিরুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। এ ধরনের আদেশ থানায় আসার কথা স্বীকার করেছেন ওসি (তদন্ত )আবুল হাসেম।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটার পর ধর্ষিতা পরিবারটি একদিকে যেমন সামাজিকভাবে লাঞ্ছনার মধ্যে থাকেন অপরদিকে ভোগেন অনিরাপত্তায়। সেখানে ধর্ষিতার পরিবারের নিকট নিরাপত্তা ও আশ্রয় হলো দেশের আইন ও প্রশাসন। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের লোক যখন ধর্ষিতা পরিবারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তখন পরিবারটি আরো অসহায় হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে পুলিশের উচিত ধর্ষিতা পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ানো এবং একইসাথে আইনি সুবিধা ও নিরাপত্তা দেওয়া। সেটা না করে পুলিশ যখন নিজেই বিচারক হয়ে যান এবং স্থানীয়ভাবে মীমাংসার ওপর ছেড়ে দেন তখন দেশের আইন ও প্রশাসনের কী কাজ? এঘটনায় উপযুক্তদের আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখিন হরার দাবি জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ