বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি এমনিতেই অস্থিরতায় আচ্ছন্ন, তার ওপর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নতুন হুংকার পরিস্থিতিকে আরেক ধাপ জটিল করেছে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে দেশজুড়ে যে অনিশ্চয়তা, বিভক্তি, এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে, এই সতর্কবার্তাটি সেই আগুনে আরও ঘি ঢেলে দিল বলা চলে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে জয় স্পষ্ট ভাষায় জানান, আওয়ামী লীগের ওপর থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে না নিলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন পণ্ড করে দেবে দলটির নেতাকর্মীরা। এমনকি তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রয়োজন হলে আন্দোলন সহিংসতার দিকেও মোড় নিতে পারে। স্বাধীনতার পর দেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে বহু উত্তাল সময় দেখা গেছে, কিন্তু একসময়ের ক্ষমতাসীন দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যের মুখে এমন বক্তব্য শোনার ঘটনা অতীতে তেমন দেখা যায়নি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। তার সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যাপক দুর্নীতি, এবং গণহত্যার অভিযোগে যখন জনতা রাস্তায় নেমে আসে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্র পুরোপুরি ভেঙে পড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেই সময়ের সহিংসতায় জাতিসংঘের রিপোর্ট মতে, মাত্র তিন সপ্তাহে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ১৪০০ মানুষ নিহত হয় এবং আহত হয় কয়েক হাজার। ১৯৭১ সালের পর এটিই দেশটির সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত। এত বড় বিপর্যয়ের দায়ে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হয়, আর সেই মামলার রায় ঘোষণার মাত্র একদিন আগে জয়ের এই মন্তব্য এসেছে। ফলে তার বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক বার্তা নয়, এটি চলমান বিচার প্রক্রিয়াকেও একধরনের চাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জয় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বসবাস করছেন, তবে দাবি করেছেন তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে আছেন। তার কথায়, ভারত তাকে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মতোই সম্মান ও নিরাপত্তা দিচ্ছে। অতীতে শেখ হাসিনা এবং ভারত সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও, নির্বাসনে থাকা অবস্থায়ও দিল্লিতে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভারত জয়দের পরিবারের প্রতি এই উচ্চমাত্রার সুরক্ষা কেন দিচ্ছে—এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা ব্যাখ্যা ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক ভূমিকা এবং দুই দেশের সম্পর্কের বিন্যাসই এর প্রধান কারণ। আবার কেউ কেউ বলছেন, ভারত বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ুক না চাইছে, তাই পূর্বতন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা রক্ষার মধ্য দিয়ে একটি বার্তা দিচ্ছে যে তারা পুরোপুরি পরিস্থিতির বাইরে নেই।
সাক্ষাৎকারে জয় বলেছেন, তার মা কী ধরনের রায় পেতে পারেন তা তারা আগেই জানেন। তিনি আভাস দিয়েছেন যে আদালত শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করবে এবং সম্ভবত মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারে। এমন বক্তব্য আদালতের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। একইসঙ্গে তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে এক ধরনের বিদ্রোহী অবস্থান দেখা গেছে—যেখানে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগকে নিয়েই তারা নির্বাচনে যেতে চান, দলটিকে নিষিদ্ধ রেখে পরিচালিত কোনো নির্বাচন তারা হতে দেবে না। দেশের ইতিহাসে অতীতে বিভিন্ন দল নির্বাচন বর্জন করেছে, নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রকাশ্য হুমকি আকারে নির্বাচন পণ্ড করে দেওয়ার ঘোষণা এ দেশে প্রথম।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন উত্তেজনা তুঙ্গে, তখন এই ঘোষণা আস্থা ও স্থিতিশীলতার সংকটকে আরও গভীরে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের অন্তর্বর্তী সরকার, যেটির নেতৃত্বে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চেষ্টা করছে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করতে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের নিষিদ্ধ হওয়া, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বাধ্য। সরকারের দাবি, দলের শীর্ষ পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধ তদন্ত এবং জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে দলটির কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। কিন্তু জয় তা মানতে নারাজ। তিনি দাবি করেন, নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তাদের দল ছাড়া কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়া বৈধ হতে পারে না।
তার বক্তব্যে যে সহিংসতার ইঙ্গিত রয়েছে, তা জনমনে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।他说েছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশে সহিংসতা শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত মুখোমুখি সংঘর্ষের অবস্থা তৈরি হতে পারে—এমন আশঙ্কা আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচনের আগে সহিংসতা নতুন নয়, কিন্তু গত বছরের গণহত্যার পর দেশের মানসিক অবস্থা এখনও খুবই তলানিতে। এর ওপর নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হলে দেশ অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলোর তীব্র নজরদারির মুখে পড়বে।
জয়ের বক্তব্যে আরেকটি লক্ষণীয় পয়েন্ট ছিল তাদের আপিল প্রসঙ্গ। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা এবং অন্য অভিযুক্তরা তখনই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন, যদি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে এবং সেই সরকারে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করে। এই বক্তব্য একদিকে বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি অবিশ্বাস দেখায়, অন্যদিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে শর্তসাপেক্ষ করে তোলে। এতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জয় বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন যে বিচার এবং নির্বাচন একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত, এবং তাদের দলকে রাজনৈতিকভাবে শ্বাসরোধ করে রাখলে তারা লড়াইয়ের পথ বেছে নেবে।
বাংলাদেশের মানুষ বহু বছর ধরে দলীয় রাজনৈতিক অস্থিরতার ভার বহন করে আসছে। বিভিন্ন সরকার পরিবর্তন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, জরুরি অবস্থা, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি—এসবই দেশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অংশ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে জনতার অভ্যুত্থান, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, নির্বাসিত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, দল নিষিদ্ধকরণ এবং আসন্ন নির্বাচনের অনিশ্চয়তা—সবকিছু একসঙ্গে মিশে আছে। এতে সাধারণ মানুষের ভীতি বাড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নানা প্রশ্ন তুলছেন, আর আন্তর্জাতিক মহল উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে ঢাকা ও দিল্লির দিকে।
এই প্রেক্ষাপটে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্য কেবল একটি ব্যক্তিগত মতামত নয়; এটি রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি অংশ, যা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গতিপথকে প্রভাবিত করতে পারে। একদিকে রয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা, যুদ্ধাপরাধ তদন্ত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার—অন্যদিকে রয়েছে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও গণতন্ত্রীকরণের দাবি। অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে, কিন্তু একই সঙ্গে বিভিন্ন শক্তির চাপ, ভেতরের দলাদলি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উজ্জীবিত হয়, কিন্তু এবার নির্বাচনকে ঘিরে যে অস্থিরতা—তা স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার চেয়ে বহু গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। জয়দের পরিবার বহু বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও অসংখ্য। সেই প্রেক্ষাপটে জয়দের বক্তব্য অনেকের কাছে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে হতে পারে, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য যে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে রাখলে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। তাই আসন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হবে কিনা, আদালতের রায় কী হবে, আওয়ামী লীগ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে—এসব প্রশ্নের ওপরই আগামী কয়েক মাসের রাজনৈতিক আবহ নির্ভর করছে।
পরিস্থিতির ভেতরে আরও একটি গভীর মেরুকরণের বাস্তবতা রয়েছে। শেখ হাসিনা সমর্থক গোষ্ঠীর একটি অংশ মনে করে বর্তমান প্রশাসন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাদেরকে টার্গেট করছে। অন্যদিকে বিরোধী শিবিরের মানুষরা বিশ্বাস করেন, অতীত দমন-পীড়নের বিচার হওয়াই উচিত এবং নতুন রাজনৈতিক ক্ষেত্র পরিষ্কার করাই দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভালো। কিন্তু এ দুই মেরুর মাঝে সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা—তা হলো শান্তি, স্বাভাবিকতা, এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়া। সহিংসতার পুনরাবৃত্তি কেউই চায় না, বিশেষ করে গত বছরের ভয়াবহ মৃত্যুযজ্ঞের স্মৃতি এখনও তাজা।
জয়ের বক্তব্যে যেমন ঝুঁকির ইঙ্গিত আছে, তেমনি রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের সম্ভাবনাও রয়েছে। যদি আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হয়, এবং দলটি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, তাহলে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পুরোপুরি বদলে যাবে। আবার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে একটি নতুন ধরনের আলোচনার দরজা খুলবে, যেখানে অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো এবং আন্তর্জাতিক মহল যৌথভাবে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু কোন পথে অগ্রগতি হবে—তা এখনো অনিশ্চিত।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের যে নতুন অধ্যায় এখন রচিত হচ্ছে, সেখানে স্থিতিশীলতা ও অস্থিরতা পাশাপাশি হাঁটছে। কিছু সিদ্ধান্ত পুরো দেশকে শান্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে, আবার কিছু সিদ্ধান্ত পুরো দেশকে ধ্বংসাত্মক সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এমন এক সংবেদনশীল সময়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্য নিঃসন্দেহে এক শক্তিশালী ঢেউ তুলেছে। এখন দেখার বিষয়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আদালত, আন্তর্জাতিক মহল এবং জনগণ—সবার ভূমিকা মিলিয়ে দেশ কোন দিকে অগ্রসর হয়। পরিস্থিতি শীতল রাখার জন্য প্রয়োজন সংলাপ, সমঝোতা এবং আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি সম্মান, কিন্তু তার বিপরীতে যদি হুমকি-ধামকি, ক্ষমতার লড়াই এবং প্রতিশোধপরায়ণতা জায়গা দখল করে, তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। দেশের মানুষ এখন তাকিয়ে আছে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের দিকে, আর জয়ের এই ঘোষণা সেই দিনের আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিল।
আপনার মতামত জানানঃ