
চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের নিস্তব্ধতায় যেন চাপা পড়ে আছে এক অদৃশ্য যুদ্ধের ইতিহাস—এক দীর্ঘ সামরিকীকরণের কাহিনি, যা এখনো চলছে নিঃশব্দে। ফটোগ্রাফার ডেনিম চাকমার প্রকল্প ‘লিভিং আন্ডার মিলিটারাইজেশন’ সেই নীরব যুদ্ধের দলিল। তার চোখে ধরা পড়েছে পাহাড়ের মানুষদের প্রতিদিনের ভয়, তাদের অসহায়তা, আর সেই রাষ্ট্রীয় নীরবতা, যা সবকিছুকে আড়াল করে রাখে। ডেনিমের লেন্স শুধু ছবি ধরে না, তুলে আনে সেই প্রশ্ন—কেন এই মানুষগুলো এখনো বন্দী নিজেদের ভিটেমাটিতেই?
২০০১ সালে শুরু হওয়া “অপারেশন উত্তরণ”-এর পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিণত হয়েছে এক প্রহরিত উপত্যকায়। সেনা ক্যাম্প, চেকপোস্ট, “ফটোগ্রাফি নিষিদ্ধ” লেখা সাইনবোর্ড—সবই যেন পাহাড়বাসীর দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। ডেনিমের শৈশব কেটেছে এই বন্দিত্বের ছায়ায়। তিনি বলেন, “আমি প্রতিদিন বন্দুকের গুলির শব্দে ঘুম ভাঙতাম। সৈন্য দেখলেই ভয় পেতাম।” তাই তার এই কাজ কোনো অনুপ্রেরণা থেকে নয়, বরং দায়িত্ববোধ থেকে জন্ম নেওয়া এক প্রতিবাদ। তার ক্যামেরা কেবল যন্ত্র নয়, বরং প্রতিরোধের প্রতীক।
ডেনিম চাকমা তার কাজকে মিশ্র মাধ্যমে উপস্থাপন করেন—ফটোগ্রাফির সঙ্গে অন্য শিল্প উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে, যাতে সরাসরি ছবি তোলা না গেলেও বাস্তবতা ফুটে ওঠে। তিনি দেখান, কীভাবে পাহাড়ে সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে নিপীড়ন। রাঙামাটি, বান্দরবান বা খাগড়াছড়িতে কেউ বেরুলেই তাকে আইডি কার্ড দেখাতে হয়, সৈন্যদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়। কোনো জেলা নয়, কেবল পাহাড়েই এই বাস্তবতা। ডেনিম বলেন, “পাহাড়ে সৌন্দর্য মানে কেবল প্রকৃতি নয়, মানুষের জীবনই এখানে আসল সৌন্দর্য। সেই জীবন যদি ভয় ও অবিশ্বাসে বন্দী হয়, তাহলে পাহাড়ের সৌন্দর্যও অর্থহীন।”
পাহাড়ের মানুষদের এই বন্দিত্বের শুরু কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্প থেকে। ১৯৬০-এর দশকে বাঁধ নির্মাণে যে সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল, তা আর ফিরে আসেনি। পাহাড়ের হাজারো পরিবার হারিয়েছে ঘর, ভূমি ও সংস্কৃতি। কাপ্তাই লেকের নীল জলের গভীরতায় আজও চাপা পড়ে আছে সেই যন্ত্রণা। উন্নয়নের নামে যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, তা আজ সামরিকীকরণে রূপ নিয়েছে। পাহাড়ের বন উজাড় হচ্ছে, নদী-নালা শুকিয়ে যাচ্ছে, পরিবেশ ভেঙে পড়ছে। উন্নয়নের প্রতিটি প্রকল্প এখন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের ওপরই আঘাত হানছে।
সম্প্রতি বান্দরবানে “আতঙ্কবাদী দমন অভিযান”-এর সময় ৪৩ জন বম নাগরিক নিহত হন। সংবাদমাধ্যমে তাদের সবাইকে “সন্ত্রাসী” হিসেবে দেখানো হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৯ জন ছিলেন সাধারণ বেসামরিক মানুষ—যার মধ্যে ১৩ বছর বয়সী এক শিশুও ছিল। ডেনিম এই ঘটনাগুলোকেই বলেন “রাষ্ট্রীয় অনুমোদিত সহিংসতা”—যেখানে রাষ্ট্রের নীরবতা নিজেই এক প্রকার অংশগ্রহণ। তার মতে, “মিডিয়াও কখনো কখনো এই সামরিকীকরণকে বৈধতা দেয়, কারণ তারা যে বয়ান প্রচার করে, তাতে অন্য কণ্ঠের জায়গা থাকে না।”
তিনি আরও দেখিয়েছেন, কীভাবে সাম্প্রতিক বছরে বম জনগোষ্ঠীর গ্রামগুলো সেনা চৌকিতে ঘেরা হয়ে পড়েছে। কোথাও যেতে হলে অনুমতি নিতে হয়, সঙ্গে পাঁচ কেজির বেশি চাল বহন করা নিষিদ্ধ। গ্রামগুলো পরিণত হয়েছে এক প্রহরিত কারাগারে। পাহাড়ি নারীরা প্রতিদিন ভয়ের মধ্যে জীবন কাটায়; যৌন হয়রানি ও নিরাপত্তাহীনতা তাদের নিত্যদিনের বাস্তবতা। ডেনিমের তোলা এক ছবিতে দেখা যায় দুই তরুণী ম্রো নারী—তাদের মুখে আলো-ছায়ার মিশ্রণে যেন ফুটে উঠেছে সেই নিঃশব্দ আতঙ্ক।
এমনকি পর্যটনের মোড়কে চলছে এক নতুন দখলনীতি। ডেনিম দেখিয়েছেন, কীভাবে এক ট্রিপুরা গ্রাম উচ্ছেদ করে তৈরি করা হয়েছে “জিগজ্যাগ পয়েন্ট” নামে পর্যটনকেন্দ্র। পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো, গ্রাম সরিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প স্থাপন—সবকিছুই এক ধরনের রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন। স্থানীয়দের জীবন, সংস্কৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আর বাইরের মানুষ সেই ধ্বংসস্তূপে ‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্য’ খুঁজছে।
ডেনিমের ছবিতে দৃশ্যমান হয় সেই নীরব প্রতিবাদ—কাপ্তাই লেকের নীল জলের নিচে ডুবে থাকা সভ্যতার আর্তি। তিনি বলেন, “যদি কাপ্তাই বাঁধ না তৈরি হতো, তবে পাহাড়ের সংস্কৃতি আজ কত রঙিন হতো! ফুলে ফুলে ভরা পাহাড়, জীবনের উচ্ছ্বাসে ভরা শহর, ভয়হীন মানুষের হাসি—এইতো হতো সত্যিকারের উন্নয়ন।” তার কাজের প্রতিটি ফ্রেমে তাই আছে ক্ষয়, বেদনা, এবং এক নিঃশেষ প্রতিরোধের রূপক।
দীর্ঘ সামরিক নিয়ন্ত্রণে পাহাড়ি সমাজে যে মানসিক অবদমন তৈরি হয়েছে, তা আজ প্রজন্মান্তরে প্রভাব ফেলছে। পাহাড়ের তরুণেরা প্রতিবাদের চেষ্টা করলেই নজরদারি ও দমননীতির মুখে পড়ে। ফলে কোনো বৃহৎ আন্দোলন গড়ে ওঠার আগেই তা নিভে যায়। এই বিভাজনমূলক রাজনীতি আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে লালিত, যাতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ কখনোই সম্ভব না হয়।
ডেনিমের ফটোগ্রাফি কেবল শিল্প নয়—এটি এক রাজনৈতিক বিবৃতি। তিনি ইতিহাসের সাক্ষী হতে চান, আবার সেই ইতিহাস মানুষকে জানানোরও দায়িত্ব নেন। “আমি চাই আমার কাজ মানুষকে ভাবতে বাধ্য করুক,” বলেন তিনি, “যদি আমার ছবিগুলো কোনোভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে, তবে সেটিই হবে আমার সাফল্য।”
শেষ পর্যন্ত তার আশাবাদ নতুন প্রজন্মের তরুণ আদিবাসী শিল্পীদের নিয়ে। তিনি বিশ্বাস করেন, পরবর্তী প্রজন্ম সাহসী হবে—তারা শিল্পকে কেবল পরিচয়ের প্রকাশ হিসেবে নয়, ন্যায়ের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করবে। তাদের কাজ হবে এমন এক কণ্ঠ, যা রাষ্ট্রের নীরবতাকে ভেদ করবে, ইতিহাসের অদেখা দিকগুলোকে আলোয় আনবে।
ডেনিম চাকমার “লিভিং আন্ডার মিলিটারাইজেশন” কেবল এক ফটোপ্রজেক্ট নয়, বরং এক আর্তনাদ—যেখানে পাহাড়ের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি নদী, প্রতিটি মুখ সাক্ষ্য দেয় এক দীর্ঘ দমনযাত্রার। তার ক্যামেরা বলে দেয়, “সৌন্দর্য” কখনো কেবল দৃশ্য নয়; সৌন্দর্য মানে সত্যকে দেখা, সাহসের সঙ্গে তা প্রকাশ করা। হয়তো ইতিহাস এই কাজটিকে শুধু নথি হিসেবে রাখবে না, বরং তা হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের জন্য এক আহ্বান—যাতে পাহাড়ের মানুষ একদিন সত্যিই মুক্ত নিশ্বাস নিতে পারে, ভয়হীনভাবে নিজেদের জীবন, সংস্কৃতি আর ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে পারে। সূত্র: নেত্র নিউজ।
আপনার মতামত জানানঃ