বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া আবারও আলোচনায় এসেছে ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশের মধ্য দিয়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্প্রতি এই ঐতিহাসিক আদেশ জারি করেছে, যা দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিমণ্ডলে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। বহু বছর ধরে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার ও আন্তর্জাতিক মহল এইসব অপরাধের বিচারের দাবি জানিয়ে আসছিল। এবার সেই দীর্ঘ অপেক্ষার কিছুটা প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বুধবার তিনটি মামলায় একাধিক নির্দেশ দেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ এবং পলাতক আসামিদের বিষয়ে সাত দিনের মধ্যে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ। এই সিদ্ধান্তে আদালতের দৃঢ় অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে—যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ছায়ায় থেকেও কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
এই মামলাগুলোর অন্যতম অংশ হলো র্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেল বা টিএফআই সেলের ঘটনায় দায়ের করা মামলা। সেখানে অপহরণ, গুম ও নির্যাতনের অভিযোগে মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জন ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—কর্নেল এ কে এম আজাদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল, কর্নেল মো. সরওয়ার বিন কাসেম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুব আলম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান।
এই তালিকাটি শুধু সংখ্যায় বড় নয়, এর প্রতিটি নাম একেকটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সামরিক বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এমন একসঙ্গে আদালতের নির্দেশে আটক হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। তাই রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে জনমনে এই সিদ্ধান্ত নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অনেকে একে ‘অবশেষে ন্যায়বিচারের সূচনা’ বলে মনে করছেন, আবার কেউ কেউ এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করছেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা হলো জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টার বা জেআইসি সংক্রান্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা। এই মামলাটি আরও বেশি আলোড়ন তুলেছে কারণ এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গুম, নির্যাতন এবং পরিকল্পিতভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এই মামলায় গ্রেপ্তার তিনজন আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে—মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিক এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজহার সিদ্দিক।
এই মামলার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও সেনা নেতৃত্ব একই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ঘটনাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, কারণ এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ উঠে আসছে, কিন্তু সেসব মামলার বেশিরভাগই তদন্তের স্তরেই থেমে গিয়েছিল। এবার আদালত যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তা হয়তো সেই অচলাবস্থা ভাঙার সূচনা হতে পারে।
তৃতীয় মামলাটি সম্পর্কিত গত বছরের জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ রামপুরা হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে। ১৮ ও ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় গুলি করে ২৮ জনকে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় চারজনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে দুইজনকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে—লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রেদওয়ানুল ইসলাম এবং মেজর রাফাত বিন আলম মুন। এই মামলায় মোট ছয়টি অভিযোগ আনা হয়েছে, যা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতাভুক্ত।
ট্রাইব্যুনাল এই তিনটি মামলার জন্য আলাদা আলাদা শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে। গুমের অভিযোগে দায়ের করা দুই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ২০ নভেম্বর, আর রামপুরা হত্যাযজ্ঞের মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে ৫ নভেম্বর। আদালত স্পষ্ট করেছে, প্রতিটি মামলাতেই দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে যাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এখন এই আসামিদের কোন কারাগারে রাখা হবে, তা নির্ধারণ করবে কারা কর্তৃপক্ষ। এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়—এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে যতদিন না সব আসামির বিচার সম্পন্ন হয়।
এই বিচার প্রক্রিয়া বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি এমন এক সময় শুরু হয়েছে, যখন রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভারসাম্য, আইনের শাসন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। বহু বছর ধরে গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক প্রকার ‘অঘোষিত বাস্তবতা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অংশ হিসেবে এমন কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে, তাদের অনেকেই এতদিন পর্যন্ত দায়মুক্তির আড়ালে ছিলেন। এখন সেই দায়মুক্তি ভাঙার এক নতুন পথ খুলে দিয়েছে এই ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের ধারণা মূলত আন্তর্জাতিক আইন থেকে উদ্ভূত, যার মূল লক্ষ্য হলো যুদ্ধকালীন বা রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল থেকেই এর সূচনা, যা পরবর্তীতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICC) ভিত্তি তৈরি করে। বাংলাদেশে প্রথম এই ধরনের ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় ১৯৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের বিচার করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাজনৈতিক পালাবদল ও সামরিক শাসনের কারণে তা কার্যকর হয়নি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আবারও এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় বহু পুরোনো ক্ষত আবার উন্মোচিত হয়েছে। অনেক পরিবার, যাদের প্রিয়জন বছরের পর বছর ধরে নিখোঁজ, তারা এখন নতুন করে আশার আলো দেখছে। আবার অন্যদিকে, সামরিক বাহিনীর মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ ও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে—কারণ দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব ও রাজনৈতিক যোগসূত্র এখন আইনের মুখোমুখি।
দেশের নাগরিক সমাজের অনেকেই মনে করেন, এই বিচার কেবল ব্যক্তিবিশেষের নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি প্রতীকী পদক্ষেপ। তবে তারা এটিও সতর্ক করে বলছেন, যদি এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে এর ফল উল্টো হতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও একই পরামর্শ দিচ্ছেন—স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও আইনি পদ্ধতির প্রতি সম্মান নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি রাজনৈতিক উত্তাল সময়ের সঙ্গে রক্ত, গুম ও নিখোঁজের বেদনা জড়িয়ে আছে। ২০১৩ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী শতাধিক ব্যক্তি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকের পরিবার এখনো জানে না তারা বেঁচে আছেন না মৃত। এই বিচারপ্রক্রিয়া হয়তো সেই অন্ধকার অধ্যায়ের কিছুটা আলো ছড়াতে পারে, যদি তা সত্যিকার অর্থে ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা। ট্রাইব্যুনালের এই পদক্ষেপ সেই ন্যায়ের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, যা শুধু ভুক্তভোগীদের জন্যই নয়, পুরো জাতির জন্যও আশাব্যঞ্জক। এই বিচার যদি পূর্ণতা পায়, তবে তা বাংলাদেশের আইনি কাঠামোকে নতুন আস্থা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবে—যেখানে ক্ষমতাও নত হয় আইনের সামনে।
আপনার মতামত জানানঃ