
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী নয়, এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রতীক। এই বাহিনীর ইতিহাস, ত্যাগ এবং অবদান আমাদের স্বাধীনতার আত্মগৌরবের সাথে জড়িত। তাই সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে এই বাহিনীকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যাতে ভবিষ্যতের যেকোনো জটিল ও কঠোর পরিস্থিতির সামনে তারা আত্মবিশ্বাসের সাথে দাঁড়াতে পারে। চট্টগ্রামের হালিশহরে সেনানিবাসে অনুষ্ঠিত বার্ষিক অধিনায়ক সম্মেলনে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এই বাস্তবতার ওপর জোর দিয়ে যে আহ্বান জানান, তা শুধু একটি আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়, বরং বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের আলোকে বাংলাদেশের সামরিক কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করারই একটি রূপরেখা।
বিশ্বের রাজনীতি এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। কখনো প্রচলিত যুদ্ধ, কখনো সাইবার যুদ্ধ, আবার কখনো অর্থনৈতিক চাপ ও কূটনৈতিক প্রভাব—রাষ্ট্রগুলোর ওপর নানান রূপের চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হচ্ছে। অতীতে যুদ্ধ মানেই ছিল সীমান্তে সামরিক সংঘর্ষ, আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ এবং দৃশ্যমান সংঘাত। কিন্তু এখন যুদ্ধের রূপ বদলে গেছে। একটি দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা, সেনাবাহিনীর প্রযুক্তিগত পিছিয়ে পড়া, অথবা গোয়েন্দা তথ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা — এসবই পরিণত হতে পারে রাষ্ট্রীয় ঝুঁকিতে। তাই সেনাবাহিনীকে শুধুমাত্র আগ্নেয়াস্ত্র বা যান্ত্রিক সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী হলেই চলে না, প্রয়োজন সমন্বিত জ্ঞান, উচ্চমানের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা এবং কৌশলগত প্রস্তুতি।
সেনাপ্রধান তাঁর বক্তব্যে এই বাস্তবতাকে সামনে এনে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের বাহিনী। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর জন্ম হয় ত্যাগ, আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধীনতার পতাকা সমুন্নত রাখার সংকল্প নিয়ে। সেই চেতনা আজও তাদের বহন করতে হয় দায়িত্ব ও সম্মানের সাথে। কিন্তু শুধু অতীতের গৌরবকে স্মরণ করলে চলবে না, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন নিজেকে সময়োপযোগী করে তোলা। আধুনিক প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ কৌশলে পারদর্শিতা, আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহারে দক্ষতা এবং পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মানসিক দৃঢ়তা—এই বিষয়গুলো একবিংশ শতাব্দীর সেনাবাহিনীর জন্য অপরিহার্য।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। যুদ্ধক্ষেত্র শুধু ভূমিতে সীমাবদ্ধ নেই। আকাশ থেকে সাইবার জগত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্র। আর্মি এয়ার ডিফেন্স কোরের উপর বিশেষ করে আকাশ নিরাপত্তা নির্ভর করে এবং পৃথিবীর যেকোনো আধুনিক সেনাবাহিনীতে এয়ার ডিফেন্স হচ্ছে কৌশলগতভাবে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ড্রোন যুদ্ধ এখন অত্যন্ত প্রচলিত। শত্রুপক্ষ কোন সময়, কোন দিক থেকে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র, অথবা ইলেক্ট্রনিক জ্যামিং আক্রমণ চালিয়ে দিতে পারে—তা পূর্বাভাস করা সহজ নয়। তাই এয়ার ডিফেন্সকে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে আরও শক্তিশালী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেনাপ্রধানের বক্তব্যে এই দিকটি স্পষ্টত তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে রেজিমেন্ট অব আর্টিলারি মাঠযুদ্ধের একটি শক্তিশালী স্তম্ভ। যেমন অতীতে প্রাচীন যুদ্ধগুলো ছিল পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল, তেমনি আধুনিক সমর কৌশলে আর্টিলারি বাহিনী হল দূরপাল্লার হামলার মূল শক্তি। তাই তাদের প্রশিক্ষণ, বাস্তবমুখী মহড়া ও প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অপরিহার্য। সেনাপ্রধান যখন বলেন, “আমাদের প্রশিক্ষণ হতে হবে বাস্তবমুখী,” তিনি মূলত বুঝিয়ে দেন যে যুদ্ধক্ষেত্রের অনিশ্চিত পরিস্থিতি, প্রতিপক্ষের হঠাৎ প্রযুক্তি পরিবর্তন, কিংবা ভূপ্রকৃতির বাধা— এসব কিছুর সাথে মোকাবেলা করার মতো মানসিক ও কারিগরি প্রস্তুতি না থাকলে কোনো বাহিনী প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী হতে পারে না।
বর্তমান বিশ্বে কেবল সামরিক শক্তি বা জনসংখ্যার ওপর নির্ভর করে টিকে থাকা যায় না। একটি দেশের সেনাবাহিনীকে কৌশলগত চিন্তাশক্তি, সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ইলেক্ট্রনিক ইন্টেলিজেন্স, স্যাটেলাইট যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং ডেটা বিশ্লেষণে দক্ষ হতে হয়। আবার একই সাথে মানবিকতা, নৈতিকতা এবং শৃঙ্খলা—এই মূলনৈতিক ভিত্তিগুলোও হারানো যাবে না। একটি সেনাবাহিনী শুধু যুদ্ধ করে না; তারা রাষ্ট্রীয় সংকটে জনগণকে সহযোগিতা করে, দুর্যোগে সহায়তা দেয়, শান্তিরক্ষা মিশনে জাতির মর্যাদা রক্ষা করে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বছর বছর আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনে যে সুনাম অর্জন করছে তা শুধু সামরিক দক্ষতার নয়, মানবিকতারও পরিচয় বহন করে।
এজন্য সেনাবাহিনীর বিকাশকে শুধু সামরিক প্রস্তুতির দিকে না তাকিয়ে একটি পূর্ণাংগ রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা উন্নয়নের অংশ হিসেবে দেখা উচিত। সামরিক প্রশিক্ষণে গবেষণা, আন্তর্জাতিক সমন্বয়, নতুন প্রজন্মের অফিসারদের চিন্তাশীল, নৈতিক, এবং প্রযুক্তি-সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। সেনাপ্রধান তাঁর বক্তব্যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, গবেষণা, এবং পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়ে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তা আসলে আগামী এক দশকে সেনাবাহিনীর গঠনমূলক রূপান্তরের সংকেত।
সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার অর্থ যুদ্ধকে উৎসাহিত করা নয়, বরং শান্তিকে সুরক্ষিত রাখা। শক্তি না থাকলে শান্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। সুতরাং আজকের প্রেক্ষাপটে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন, সীমান্ত উত্তেজনা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ, আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা—এসব ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে, সেখানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশের জন্য সেনাবাহিনীকে আধুনিকীকরণ শুধু প্রয়োজন নয়, অপরিহার্য।
এই কারণেই সেনাপ্রধানের আহ্বান রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোকে আরও দৃঢ়, সুসংগঠিত এবং ভবিষ্যৎ সক্ষমতা সম্পন্ন করার একটি পর্যালোচনামূলক বাস্তব বার্তা। সামনের দিনে বিশ্ব কীভাবে পরিবর্তিত হবে কেউ জানে না, কিন্তু যে বাহিনী প্রস্তুত থাকবে, শৃঙ্খলিত থাকবে, জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ থাকবে—তারাই জাতির নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষা করতে পারবে।
 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
আপনার মতামত জানানঃ