বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অভ্যুত্থানের পর আবারও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। দেশি–বিদেশি বিভিন্ন মহল থেকে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমানোর আহ্বান জানানো হলেও বাস্তবে সেই দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। আগে যেসব বিষয়কে প্রস্তাব বলা হয়েছিল, এখন তা শর্তে পরিণত হয়েছে। এতে শেষ মুহূর্তে এসে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি আরও তীব্র হয়েছে।
প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলেও তারা প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) পদ্ধতি মানতে রাজি নয়। এমনকি উচ্চকক্ষের ক্ষেত্রেও তারা আপত্তি জানিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, PR পদ্ধতি ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। গণভোট, জুলাই সনদ এবং সংস্কার বাস্তবায়নের সময়সীমা নিয়েও তাদের অবস্থান ভিন্ন। ফলে ঐকমত্য কমিশনের নিয়মিত বৈঠক হলেও বাস্তবে কোনো ঐকমত্য গড়ে উঠছে না।
জামায়াতের অবস্থান সবচেয়ে জটিল। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা সবচেয়ে বেশি অর্জন করেছে। অন্তত ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে গেছে, প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে তাদের সমর্থকরা অবস্থান করছে, এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যেও তারা এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করছে। তাই তাদের ভয়—যদি এখন নির্বাচন হয় এবং বিএনপি সর্বাধিক আসন লাভ করে, তাহলে এই সমস্ত অর্জন হুমকির মুখে পড়বে কিংবা হারিয়ে যাবে। এজন্যই জামায়াত নির্বাচনের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না এবং প্রতিনিয়ত বিএনপির জন্য অগ্রহণযোগ্য নতুন শর্ত আরোপ করছে।
অন্যদিকে এনসিপির সমস্যাও কম নয়। দলটি এখনো সংগঠিত হতে পারেনি, নিবন্ধনও পায়নি। দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে তারা প্রচণ্ড চাপের মুখে রয়েছে। এরই মধ্যে দুজন উপদেষ্টাকেও সরে যেতে হচ্ছে। তাই তাদের বিশ্বাস, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে ভালো ফল আসবে না। ফলে তারাও ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। এনসিপি প্রধান নাহিদ ইসলামও ইঙ্গিত দিয়েছেন, হয়তো ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হচ্ছে না।
এই অবস্থায় বিএনপির সামনে নির্বাচন ছাড়া কার্যকর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু জামায়াত ও এনসিপির শর্ত মেনে চলা তাদের জন্য কার্যত অসম্ভব। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্বাচন না হলে কেবল বিএনপি নয়, জামায়াত ও এনসিপিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জনগণের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়বে, অভ্যুত্থানের চেতনা হিংসায় বিলীন হয়ে যেতে পারে। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী ফৌজিশাসন কিংবা উগ্রবাদী শক্তির উত্থানের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সব মিলিয়ে বলা যায়, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত তিন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে অনৈক্য বাংলাদেশের রাজনীতিকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ঐকমত্যে পৌঁছানো না গেলে দেশ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোবে—যেখানে নির্বাচন স্থগিত হয়ে সহিংসতা, ফৌজিশাসন বা উগ্রবাদী শক্তির উত্থান—যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ