বাংলাদেশ থেকে একটি সাত সদস্যের আলেম প্রতিনিধি দল হঠাৎ করে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে পৌঁছেছে — নেতৃত্বে রয়েছেন খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক। দলটি, তাদের বলা মতো, “ওলামা সমাজের” প্রতিনিধিদল হিসেবে তালেবান সরকারের আমন্ত্রণে গিয়েছে; সেখানে তারা তালেবান শীর্ষ নেতারা, বিচারপতি ও মন্ত্রিত্বের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করবেন যোগ্যতা অনুযায়ী।
সফর বলে দলীয় নয় — এই দাবি দলটির পক্ষ থেকে জোর দিয়েই করা হয়েছে। তবু সেই দফা দাবি ও সফরের সময়সূচি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ: ঢাকায় একই সময়ে খেলাফত মজলিস তাদের ঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচি চালাচ্ছে এবং দলের অভ্যন্তরীণ-রাজনৈতিক পরিচিতি ও জনগণের ভাবমূর্তির ভাবনায় এই সফর নতুন প্রশ্ন তোলে। রেজিস্ট্রার হিসাবে দল বলছে, সফরটি মূলত আলেমদের মধ্যকার সম্পর্ক-উন্নয়ন, ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় আলোচনা ও মানবিক/শিক্ষা-ওষুধসহ বাণিজ্যিক সহযোগিতার সম্ভাবনা খোঁজা ইত্যাদি নিয়ে; তবু দর্শনীয় যে সফরের অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে থাকা ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচিতি বিষয়টিকে স্বতন্ত্র মাত্রা দেয়।
দলের বক্তব্য অনুকরণ করলে সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অজানা দিক হলো — পশ্চিমা বিশ্বে তালেবান শাসনের ওপর যে মানবাধিকার ও বিশেষ করে নারীর অধিকার সম্পর্কিত সমালোচনা আছে, তা যাচাইয়ের ইচ্ছা তাদের। প্রতিনিধি দল সূত্র জানায়, তারা চাইবে বাস্তবে কেমন পরিস্থিতি তা নিজ চোখে দেখে “বস্তুনিষ্ঠ” ধারণা তৈরি করতে; পশ্চিমা মিডিয়ায় ছড়ানো বিবরণে বিভ্রান্তি থাকতে পারে বলে তারা মনে করছেন। এই ব্যাখ্যা অংশত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বহন করতেই পারে — দেখার বিষয় সফর শেষে তাদের প্রতিবেদন কিভাবে উপস্থাপিত হয়।
তবে সফরের বহুবিধ অর্থ আছে এবং সেটা রাজনৈতিক-সমাজগত ভিন্ন স্তরে পড়ে। প্রথমত, বাংলাদেশের কোনো বড় রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতার এই ধরনের আফগানিস্তান সফর বিরল; এমন ঘটনা আগে নজির হিসেবে দেখা যায় না—আসলে এটাই প্রথমবারের মতো বলা যায় যে কোনো দলের নেতাদের এমন সফরের খবর সামনে এসেছে। ফলে জন্ম নেয় নানা প্রশ্ন: ঐতিহাসিকভাবে তালেবান শাসিত আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার পরিবর্তিত জবাবদিহিতার ভেতরকে কীভাবে বাংলাদেশি রাজনৈতিক মহল দেখে? আমন্ত্রণমূলক এই সফর কোনো কূটনৈতিক ‘চ্যানেল’ হিসেবে কাজ করছে নাকি এটা শুধুই ধর্মীয়-আলোচনার একটি ক্রম?
দ্বিতীয়ত, নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিদের পরিচয় মূল্যবান ইঙ্গিত দেয়। দলের সঙ্গে থাকা আলেমদের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন শীর্ষনেতাও আছেন—অর্থাৎ এটি কেবল “অরাজনৈতিক আলেম-দল” মাত্র নয়, বরং ধর্মীয় সংগঠন ও রাজনৈতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের মিশ্রণ। এই মিলবন্ধন দেখে বিশ্লেষকরা সতর্ক: আফগানিস্তানের রাজনীতিক ও সামাজিক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে কোনোভাবে অনুকরণীয় নকশা তৈরির উদ্দেশ্য বহন করতে পারে কি না, সেটাই তারা খতিয়ে দেখছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগান মডেলের ‘রিজিড শরীয়ার’ ধরনে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ পরিবেশ থাকায় সেটি সরাসরি বাংলাদেশে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়; তবু কোন অনুপ্রেরণা বা ভাবমূর্তির আমদানি রাজনীতিকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।
তৃতীয়ত, সফরের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক আঙ্গিকে কথাও আছে: দল বলছে তারা দুই দেশের আলেমদের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে চায় এবং আফগানিস্তানের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা দেখতে যাবে—সবই ‘মুক্তিযোদ্ধা মানবিক’ বা ‘সাংস্কৃতিক বিনিময়’র আড়ালে বিস্তার করা যায়। কিন্তু বাস্তবে তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের সাথে যে ধরনের যোগাযোগ গড়ে ওঠে, সেটি আন্তর্জাতিক কুটনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে—বিশেষত তখন যখন আফগানিস্তানকে সরকারিভাবে বেশিরভাগ দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। এই যোগাযোগ কোনো রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করলে ঢাকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মানচিত্রে তা প্রতিফলিত হবে।
সফরের সময়ে যে সামাজিক-রাজনৈতিক বিবেদ আছে, তা অন্তত দুইভাবে বিভক্ত জনপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সরকারের প্রতি সমর্থক মহল ও ধর্মীয় সমর্থক মহল এই সফরকে ভিন্নভাবে দেখছেন—কেউ বলছেন এটি আলেমদের ধর্মীয় ও মানবিক সফর, অন্যরা ভাবছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ধারণ করে। খোলাখুলি যে কোনো প্রতিষ্ঠিত কূটনৈতিক ভাবনা না থাকায় সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছেই। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে যে সফরটি সৌদি আরব ও দুবাই হয়ে এসেছে; ওমরাহ পালন শেষে প্রতিনিধিরা আফগানিস্তানে গেছেন—এই তৎপরতায় বহু পর্যবেক্ষক প্রশ্ন করছেন সফরের সময়ে দলের ঢাকার বিক্ষোভ কর্মসূচি কেন স্থগিত হয়নি বা কিভাবে সামঞ্জস্য বজায় রাখা হলো।
এই ঘটনাকে প্রসঙ্গ করার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট। ২০০১-এর আগে আফগানিস্তানে তালেবান শাসন ছিল; তখনও আলেমদের মধ্যে গমনাগমন ছিল—কিন্তু সেবার রাজনীতির ও সামাজিক নীতির প্রকৃতি এখনকার তালেবানের সঙ্গে তুলনা করলে ভিন্ন। গত দশকে তালেবান সরকারের নীতিগুলোতে নারীর শিক্ষাসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে—এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বন্ধের মতো নির্দেশনা আসে; মানবাধিকার অঙ্গীকার নিয়ে পশ্চিমা সমালোচনাও তীব্র। বাংলাদেশের আলেম প্রতিনিধিদল কবে ও কিভাবে সেই বাস্তবতার সঙ্গে মেলে—এটাই মূল প্রশ্ন। অনেকে বলছেন, যদি উদ্দেশ্য ‘পর্যবেক্ষণ’ হয়, তবে ফেরার পর তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করা উচিত যাতে দেশের জনসাধারণ সত্যটি জানতে পারে, কেবল মুদ্রিত প্রাসঙ্গিক বক্তৃতা নয়।
অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেন—একটি ধর্মীয় বা আলেম-সফরের আড়ালে যদি আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত শাসন ও নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক বন্ধন গড়ে ওঠে, তা ভবিষ্যতে দেশে রাজনৈতিক আদর্শ বা নীতির বদলে ‘বাহ্যিক অনুকরণ’ আনার ভূমিকায় কাজ করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক মনে করেন, বাংলাদেশে যদি কোন শ্রেণির মানুষ আফগান মডেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তারা হয়তো দর্শনগতভাবে কিছু ধারণা নিতে চাইবে; কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ও সামাজিক বিন্যাস, নাগরিক অধিকারের কাঠামো ও জনমানসিকতা দিয়ে যে রিজিড-মডেল বাস্তবায়ন সম্ভব নয়—তাই যে কোনো “প্রদক্ষিণমূলক” অনুকরণ ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
শেষে, এই সফর যদি কেবল আলেমদের মধ্যে সম্পর্ক-বিকাশ ও মানবিক পর্যবেক্ষণের ঘোষণা থেকে বেশি কিছু না হয়, তবু তার প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল নীরব থাকবে না। বিদেশে সংগঠিত কোনো রাজনৈতিক-ধর্মীয় সমন্বয়, বিশেষত যখন তা এমন একটি বিতর্কিত শাসন ব্যবস্থা নিয়ে মেলামেশা করে, দেশের রাজনীতি, কূটনীতি ও সমগ্র সমাজে প্রশ্ন জাগাবে—এবং সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে দলের পক্ষকেও। সফর শেষে দলের থেকে স্পষ্ট, তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন, যে কোনো সভার আলোচ্যসূচি ও তালেবান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সঠিক সাক্ষাৎকার-নথি প্রকাশ করা হলে জনমতকে তথ্যভিত্তিকভাবে গঠনে সহায়তা করবে। না হলে গুঞ্জন ও রাজনৈতিক আঘাতই বাড়বে।
আপনার মতামত জানানঃ