
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতীক মানে শুধু একটি চিহ্ন নয়, এটি পরিচয়ের প্রতীক, ইতিহাসের প্রতিফলন এবং ভোটের রাজনীতির প্রাণ। প্রতীক নিয়েই জেগে ওঠে দলের আবেগ, নেতাদের দাবি এবং সমর্থকদের ভালোবাসা। নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে নতুন একটি প্রতীক—‘শাপলা কলি’। একদিকে এটি নতুন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জন্য আনন্দের খবর, অন্যদিকে এটি আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা ও বৈচিত্র্যের প্রতীক।
নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫১। নতুন এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মোট ১১৯টি প্রতীককে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫১টি প্রতীক থাকবে নিবন্ধিত দলগুলোর জন্য, বাকি প্রতীকগুলো ভবিষ্যতে নিবন্ধন পাওয়া দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। শাপলা কলি প্রতীকটি বরাদ্দ হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর জন্য, যারা দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতীক দাবি করে আসছিল। বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫-এ নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদের স্বাক্ষরে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে প্রতীকের ভূমিকা সব সময়ই গভীর। দেশের ভোটারদের একটি বড় অংশ এখনো প্রার্থীকে নামের চেয়ে প্রতীক দিয়েই চেনে। বিশেষ করে গ্রামীণ ভোটারদের কাছে ‘ধানের শীষ’, ‘নৌকা’, ‘লাঙ্গল’ বা ‘হাতপাখা’ মানেই একটি দল, একটি মতাদর্শ, একটি স্মৃতি। তাই প্রতীক নিয়ে রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা ও দাবি-দাওয়ার বিষয়টি বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। এই বাস্তবতায় ‘শাপলা কলি’র মতো নতুন প্রতীক যুক্ত হওয়া এক অর্থে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের প্রসার ও বৈচিত্র্যের ইঙ্গিত দেয়।
শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় প্রতীকে, ডাকটিকিটে, এমনকি টাকাতেও শাপলার ছাপ রয়েছে। সেই শাপলা এখন রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা অনেকের কাছে স্বাভাবিকও বটে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রতীক দাবি করে আসছিল। তাদের মতে, শাপলা প্রতীক শান্তি, ঐক্য ও স্বচ্ছতার প্রতীক। এখন সেই দাবি পূরণ হওয়ায় দলটির নেতারা বলছেন, এটি তাদের রাজনৈতিক স্বীকৃতির একটি বড় পদক্ষেপ।
বাংলাদেশে প্রতীকের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ‘ধানের শীষ’ প্রতীকই ভোটের মাঠে পরিচিতি পেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরও অনেক প্রতীক—‘লাঙ্গল’, ‘মশাল’, ‘কাস্তে’, ‘তারা’, ‘হাত’, ‘বই’, ‘বাঘ’—প্রতিটি প্রতীক একটি দলকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছে। প্রতীক শুধু নির্বাচনের সময় ব্যবহৃত হয় না, এটি দলের ব্যানার, পোস্টার, সভা-সমাবেশ এমনকি রাজনৈতিক বক্তব্যেও ব্যবহৃত হয়। বলা যায়, প্রতীকই বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতির ভাষা।
বর্তমান প্রতীক তালিকা বেশ সমৃদ্ধ। এখানে রয়েছে আপেল, আনারস, কোদাল, খাট, টেবিল ঘড়ি, ফ্রিজ, মোড়া, ট্রাক, বক, মোরগ, আম, খেজুর গাছ, টেলিফোন, বাঘ, রকেট, আলমিরা, গরুর গাড়ি, টেলিভিশন, বই, রিকশা, ঈগল, গাভি, ডাব, বটগাছ, লাউ, উটপাখি, গামছা, ঢেঁকি, বাঁশি, লিচু, উদীয়মান সূর্য, গোলাপ ফুল, তবলা, বেঞ্চ, লাঙ্গল, একতারা, ঘণ্টা, তরমুজ, বেগুন, শঙ্খ, কাঁচি, ঘুড়ি, তারা, বাইসাইকেল, সোনালী আঁশ, কবুতর, কলম, ঘোড়া, থালা, বালতি, সেলাই মেশিন, চাকা, দাঁড়িপাল্লা, বেলুন, সোফা, কলস, চার্জার লাইট, দালান, বৈদ্যুতিক পাখা, সিংহ, কলার ছড়ি, চাবি, দেওয়াল ঘড়ি, মই, কাঁঠাল, চিংড়ি, দোয়াত কলম, মগ, সুটকেস, হরিণ, চেয়ার, মাইক, হাত, কাস্তে, চশমা, ধানের শীষ, মটরগাড়ি, হাতঘড়ি, নোঙ্গর, মশাল, হাতপাখা, কুমির, ছাতা, নৌকা, ময়ূর, হাঁস, কম্পিউটার, প্রজাপতি, মাছ, কলা, কুড়াল, ফুটবল, টিউবওয়েল, ফুলকপি, মিনার, কুলা, টিফিন ক্যারিয়ার, ফুলের টব, মোমবাতি, কুঁড়ে ঘর, টেবিল, ফুলের মালা, মোবাইল ফোন, হাতি, হাতুড়ি, হারিকেন, হুক্কা ও হেলিকপ্টার।
এই বিশাল তালিকাটি শুধু রাজনীতির নয়, বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতিরও প্রতিফলন। প্রতীকগুলো এক অর্থে আমাদের গ্রামীণ জীবনের পরিচিত জিনিসগুলোকেই প্রতিনিধিত্ব করে। একজন কৃষক লাঙ্গল বা ধানের শীষ চেনে, একজন শহুরে মানুষ রিকশা বা বই চিনে, একজন তরুণ হয়তো মাইক বা মোবাইল ফোনে বেশি পরিচিত। তাই এই প্রতীকগুলো আমাদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
তবে প্রতীক নিয়ে বিতর্কও নতুন নয়। অনেক সময় একাধিক দল একই প্রতীক দাবি করে, আবার কেউ কেউ প্রতীকের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক দেখিয়ে আদালতে যান। ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে ‘লাঙল’ ও ‘ধানের শীষ’ নিয়ে এমন বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। নির্বাচন কমিশনকে তখন নানা পক্ষের শুনানি নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হয়েছিল। শাপলা কলি নিয়েও জাতীয় নাগরিক পার্টি ও আরও একটি ছোট দল এক সময় দাবি করেছিল। অবশেষে নির্বাচন কমিশন যাচাই-বাছাই করে শাপলা কলি এনসিপির নামে বরাদ্দ দেয়।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতীক বরাদ্দের প্রক্রিয়া অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক। কোনো দল নিবন্ধন পেলে তারা তিনটি সম্ভাব্য প্রতীক প্রস্তাব করতে পারে। এরপর কমিশন তালিকা পর্যালোচনা করে দেখে কোন প্রতীক আগে ব্যবহৃত হয়েছে, কোনটি সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয়ভাবে সংবেদনশীল নয়, এবং কোনটি জনগণের কাছে সহজবোধ্য। সেই অনুযায়ী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।
এই প্রতীক সংস্কৃতি এখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতীক দিয়েই জনগণ রাজনীতিকে চেনে, দলকে চিনে, প্রার্থীকেও চেনে। এমনকি অনেক সময় গ্রামের মানুষ প্রার্থীর নাম না জেনেও শুধু প্রতীক দেখেই ভোট দেন। তাই প্রতীকের প্রতি দলের আবেগ স্বাভাবিক।
নতুন প্রতীক যুক্ত হওয়ার মানে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানও। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের রাজনৈতিক পরিসরে নতুন দলগুলোর আবির্ভাব ঘটছে—কেউ তরুণদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করছে, কেউ জাতীয় ঐক্যের বার্তা দিচ্ছে। তাদের জন্য প্রতীক মানে কেবল একটি চিহ্ন নয়, বরং নিজেদের অস্তিত্বের প্রতীক। শাপলা কলি হয়তো আগামী নির্বাচনে এমনই এক নতুন নাম হয়ে উঠবে—একটি দলের, একটি আশার, একটি স্বপ্নের প্রতীক হিসেবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন অনেক কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে—প্রযুক্তি, প্রচার কৌশল, প্রার্থীদের ধরন, ভোটারদের মনোভাব। কিন্তু প্রতীক এখনো অটুট। পোস্টারে, ব্যানারে, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রতীকের গুরুত্ব কমেনি। ‘নৌকা’, ‘ধানের শীষ’, ‘লাঙ্গল’—এই প্রতীকগুলো আজও মানুষের আবেগে বাস করে। সেই সারিতে হয়তো এখন যুক্ত হলো একটি নতুন ফুল—‘শাপলা কলি’।
প্রতীক নিয়ে রাজনীতি হয়তো কখনোই শেষ হবে না। কারণ প্রতীক মানেই স্মৃতি, পরিচয় আর আবেগের মিশ্রণ। বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতির এই বহুরঙা প্রতীকগুলো কেবল ভোটের চিহ্ন নয়, এগুলো আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের জীবনের গল্পও।
আপনার মতামত জানানঃ