রাজধানীর ব্যস্ততম কেন্দ্র বিমানবন্দর রেলস্টেশনে আজ রোববার দুপুরে ঘটে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে উদ্ধার করা হয় অস্ত্র ও বিস্ফোরকভর্তি একটি ট্রলি ব্যাগ। এতে ছিল ৮টি বিদেশি পিস্তল, ১৬টি ম্যাগাজিন, ২৬ রাউন্ড গুলি, ২ দশমিক ৩৯ কেজি গান পাউডার এবং ২ দশমিক ২৩ কেজি প্লাস্টিক বিস্ফোরক। এমন ঘটনায় গোটা রেলওয়ে স্টেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে দেখা দেয় ব্যাপক তৎপরতা। সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও রেলওয়ে পুলিশের সমন্বয়ে পরিচালিত বিশেষ অভিযানে এসব বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়।
ঘটনার শুরু আজ সকাল সোয়া ১১টার দিকে। সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিট সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান শুরু করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনটি বিমানবন্দর স্টেশনে প্রবেশ করার পরেই ডগ স্কোয়াডসহ অভিযান চালানো হয়। ট্রেনের একটি নির্দিষ্ট বগি ঘিরে ফেলা হয় এবং তল্লাশি শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনের লাগেজ ক্যারেজ থেকে একটি নীল রঙের ট্রলি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়, যা সন্দেহজনক মনে হয় সেনাসদস্যদের কাছে। ব্যাগটি খুলতেই বেরিয়ে আসে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
ঢাকা জেলা রেলওয়ে পুলিশের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন জানান, সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় অভিযানটি পরিচালিত হয় এবং তারা উদ্ধারকৃত সামগ্রীর প্রাথমিক তথ্য পুলিশকে দিয়েছে। “তবে কতগুলো অস্ত্র বা গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে, তার সঠিক হিসাব এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। সেনাবাহিনীর প্রতিবেদন পাওয়ার পরই বিস্তারিত বলা যাবে,” বলেন তিনি। পরে সেনাবাহিনীর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিশ্চিত করা হয় উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও বিস্ফোরকের বিস্তারিত।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, আটক ব্যক্তিরা ট্রেনের যাত্রী ছিলেন এবং ট্রলি ব্যাগটি তাদের সঙ্গেই ছিল। তবে অস্ত্রগুলো ঢাকায় আনা হচ্ছিল কার উদ্দেশ্যে এবং কার নির্দেশে—সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিষয়টি নিয়ে গভীর অনুসন্ধান শুরু করেছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের এমন ঘটনা খুব বেশি দেখা যায়নি। বিশেষ করে রাজধানীর প্রবেশপথের অন্যতম এই রেলস্টেশনে এমন উদ্ধার গোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তঘেঁষা এলাকা হওয়ায় সেখান দিয়ে অবৈধ অস্ত্র পাচার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এবার হয়তো সেই অস্ত্র রাজধানীতে পৌঁছানোর আগেই আটক হয়েছে।
বিমানবন্দর স্টেশনের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুরের দিকে হঠাৎ সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে স্টেশনজুড়ে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যাত্রীরা বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী ঘটছে। কিছুক্ষণ পর সেনা সদস্যদের দেখা যায় একে একে ট্রেনের বগি ঘুরে দেখতে। এরপরই তারা একটি ব্যাগ উদ্ধার করে তা নিয়ে যায় একটি নির্দিষ্ট জায়গায়। পরে খবর পাওয়া যায়, ব্যাগটিতে বিপুল অস্ত্র ও বিস্ফোরক ছিল।
রেলওয়ে পুলিশের সূত্র জানায়, উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদেশি পিস্তল, যা অধিকাংশই উন্নতমানের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এগুলো সাধারণত সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান হয়ে আসে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো কোনো সংঘবদ্ধ চক্রের কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তায় এখন পুরো নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
অভিযানে অংশ নেওয়া সেনা কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি ছিল একটি যৌথ অভিযান, যা পূর্বপ্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে। “আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, বনলতা এক্সপ্রেসে অবৈধ কিছু পরিবহন করা হচ্ছে। সেই সূত্র ধরেই অভিযান চালানো হয়। উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও বিস্ফোরক রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হতে পারত,” বলেন এক কর্মকর্তা।
অন্যদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা স্টেশন এলাকায় কড়া নিরাপত্তা জোরদার করেছে। যাত্রীদের লাগেজ তল্লাশি ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ট্রেন চলাচলে যদিও সাময়িক কিছু বিলম্ব ঘটে, তবে বিকেল নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধারকৃত সামগ্রী পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তা রেলওয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন।
রেলওয়ে থানায় ইতিমধ্যে একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও বিস্ফোরক পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ টিম ডাকা হবে। সেগুলোর উৎপত্তি দেশীয় না বিদেশি, তা জানার জন্য বালিস্টিক পরীক্ষাও করা হবে।
বনলতা এক্সপ্রেস বাংলাদেশের অন্যতম আধুনিক বিরতিহীন ট্রেন, যা সপ্তাহে ছয় দিন ঢাকা-রাজশাহী রুটে চলাচল করে। এই ট্রেনের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক যাত্রী প্রতিদিন রাজধানীতে আসা-যাওয়া করে। এমন একটি জনপ্রিয় ট্রেন ব্যবহার করে অপরাধীরা অস্ত্র পাচারের চেষ্টা করবে, তা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর বলে মনে হয়েছে।
অভিযানের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে প্রশংসা করেছেন সেনাবাহিনীর দ্রুত ও দক্ষ তৎপরতার জন্য, যা সম্ভবত একটি বড় ধরনের নাশকতা প্রতিহত করেছে। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, কীভাবে এমন বিপুল অস্ত্র ট্রেনে উঠতে পারল, সেখানে নিরাপত্তা তল্লাশির ঘাটতি কোথায়।
বর্তমানে আটক চারজনের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আরও অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো মনে করছে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি বড় চক্রের অংশ। তদন্তে নতুন কোনো তথ্য বেরিয়ে আসলে তা প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও সামনে এলো সীমান্তপথে অবৈধ অস্ত্র প্রবাহ ও রাজধানীতে তা ছড়িয়ে দেওয়ার ঝুঁকি। তবে সময়মতো সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায় হয়তো একটি সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়ানো গেছে। এখন সবার নজর তদন্তের অগ্রগতির দিকে—কারা এই চক্রের মূল হোতা, কী উদ্দেশ্যে এত বিপজ্জনক অস্ত্র ঢাকায় আনা হচ্ছিল, আর কোথায় তা ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল—এসব প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে ঘটনার পরবর্তী ধারা।
আপনার মতামত জানানঃ