জেলা প্রশাসন থেকে ২০ জন দালালের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অভিযুক্ত দালালদের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
দালালদের অনুসন্ধানের জন্য তালিকা ইতোমধ্যেই দুদকে প্রেরণ করেছে প্রশাসন। তালিকার শীর্ষ দালাল নাসির কাজীর বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, সে প্রায় দুই বছর ধরে পলাতক। এক সময়ের গ্রাম্য পশু চিকিৎসক নাসিরের ঢাকা, কক্সবাজার ও দেশের বাইরে দুইশ’ কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে বলে তার সহযোগীরা দাবি করেন। যে সকল সহযোগী দিয়ে দালালরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তাদের কেউ কেউ জেলও খেটেছে।
অনুসন্ধান করতে গিয়ে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শিবচরের ডাইয়ারচর মৌজায় পদ্মা সেতুর রেল লাইনে ক্ষতিগ্রস্ত হারুন বেপারি, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার বেগম ও ছেলে মেহেরাব হোসেনসহ পাশর্^বর্তী দোকানঘর ও জমির জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৪ ধারা, ৭ ধারা ও ৮ ধারা নোটিস পান। তবে নোটিস পেয়ে ডিসি অফিসে বারবার ঘুরেও বিল পাচ্ছিল না তারা।
দীর্ঘ চেষ্টার পর ক্ষতিগ্রস্তরা জানতে পারেন ওই দাগগুলো থেকে ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে তুলে নিয়ে গেছে দালালরা। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় এই ভুয়া বিল উঠানোর অভিযোগে শাহীন বেপারি নামের এক দালালকে আটক করে পুলিশ। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি মামলায় আসামি হয় জেলা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত শীর্ষ দালাল নাসির কাজী, তার দুই মামা ও এক নিকটাত্মীয়।
আসামিদের কেউ ওই এলাকার বাসিন্দা না হওয়া সত্ত্বেও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক শ্রেণির কর্মচারীর সহায়তায় এ দফায় প্রায় দুই কোটি টাকা লোপাট হয়। গ্রেপ্তারকৃত শাহীনের পরিবার (দালাল নাসিরের সহযোগী) আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। শাহীনের নামে প্রায় ২ কোটি টাকার বিল ছাড় হলেও লোপাটকৃত টাকার মাত্র ২০ লাখ টাকা ভাগ পায় তারা। বাকি টাকা নেয় নাসিরসহ অফিসের লোকজন।
বিল তোলার আগে সব দায়ভার দালাল চক্র নিতে চাইলেও এখন তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শুধু শাহীন বেপারিই নয়, চক্রটির লোভে পা দিয়ে দুই লাখ টাকা ভাগ পেয়ে জেল খাটেন ইউপি সদস্য শুধাংশু ম-ল। দুই লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও ৪৫ হাজার টাকা ভাগ পেয়ে তদন্তের মুখে পড়েছেন আলো পত্তনদারসহ আরও অনেকে। এছাড়াও চক্রটি বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ভিপি ও খাস সম্পত্তি থেকে দাবি এক সময়ের সহযোগীদের।
ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্ত হারুন বেপারি বলেন, ‘আমাদের জমির সকল কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও অন্য এলাকার বাসিন্দা দালাল নাসির, শাহীনসহ দালাল চক্রটি ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ডিসি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সহায়তায় জালিয়াতির মাধ্যমে বিলের প্রায় এক কোটি ৮৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে গেছে। এই অঞ্চলে এদের কোনো জমিও নেই। যার কারণে আমরা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্ষতিপূরণের টাকা এখনো পাইনি। দালাল নাসির এবং তার দুই মামাকে আটক করতে পারলে অনেক টাকা উদ্ধার করা যাবে। চক্রটি জালিয়াতির মাধ্যমে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।’
আরেক ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্ত খোকন সিকদার বলেন, ‘ডিসি অফিসের এলএ শাখার সাবেক সার্ভেয়ার রাসেল ও মোস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে চাকরিচ্যুত) কারসাজি করে দালাল নাসিরের সহযোগী গ্রেপ্তারকৃত শাহীনের নামে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে দিয়ে আমাদের জমির ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করে দিয়েছে। আমাদের ছয়জনের মালিকানাধীন ৬৪২ নং দাগের জমি দেখিয়ে প্রায় এক কোটি ৮৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দালাল চক্রটি। চক্রটি এছাড়াও ভিপি ও খাস খতিয়ানের কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শুধু ভুয়া কাগজ দিয়ে।’
গ্রেপ্তারকৃত শাহীন বেপারির ছেলে জালাল বেপারি বলেন, দালাল নাসির, আলিউজ্জমান, আক্তারুজ্জামানসহ ওরা কয়েকজন মিলে আমার বাবাকে দিয়ে টাকা উত্তোলনের এই কাজটি করিয়েছে। জাল কাগজপত্র তৈরি করেছে নাসিরের মামা আক্তারুজ্জামান। আমার বাবার ব্যাংক একাউন্টে এক কোটি ৮৮ লাখ টাকা আসলে নাসির, আক্তারুজ্জামানরা তাকে ভয় দেখিয়ে দুই চেকের মাধ্যমে সকল টাকা ওদের একটি অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে নেয়। এরপর বাবাকে ২০ লাখ টাকা দেয়।
এত বড় ঘটনা আবার বাবা আমাদের পরিবারের কাউকেই বলেননি। পরে যখন সরকারি কর্মকর্তারা তদন্তে আমাদের বাড়ি আসেন তখন আমার বাবা তাদের কাছে সকল ঘটনা খুলে বললে আমার বাবাকে তারা ডিসি অফিসে যেতে বলেন।
আমার বাবা ডিসি অফিসে গেলে ডিসি সাহেব সকল কথা শোনার পর আমার বাবাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়। এত বড় ঘটনার যারা হোতা তাদের এখনো পুলিশ ধরতে পারেনি। তার মধ্যে আক্তারুজ্জামান আর আরেকজন জামিনও পেয়ে গেছে। এত বড় দালালরা কিভাবে জামিন পায়?
দালাল নাসির কোথায় আছে কেউ জানে না। আর নজরুল সম্ভবত ঢাকায় আছে। কিন্তু ওদের বাড়ির লোকজন ঠিকানা বলে না। আমার বাবাকে আটকের পর ওদের কাছে গিয়েছিলাম তখন ওরা কোনো সহযোগিতা করেনি। বরং ওরা বলেছে আমাদের না জানিয়ে তোমার বাবা পুলিশের কাছে ধরা দিল কেন? এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না।
গ্রেপ্তারকৃত ইউপি সদস্য শুধাংশ ম-ল (নাসিরের সহযোগী) বলেন, কোনো জমির মালিক আছে আর কোনো জমির মালিক নেই এ সকল ফাঁক ফোকর তো কানুনগো ছাড়া আর কেউ জানে না।
ডিসি অফিসের এ সকল কর্মকর্তা কর্মচারীরা দালাল নাসিরের সঙ্গে যোগাযোগ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি হলে হিন্দু ধর্মের লোক, জেলেদের জমি হলে জেলে সম্প্রদায়ের লোক সেট করে শুধু আইডি কার্ড নিয়ে বাকি জমির সকল কাগজপত্র জাল দলিল তৈরি করে ওরা ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করেছে।
আমার ধারণা নাসির কাজী, মতিউর কাজী, নাসিরের দুই মামাসহ চক্রটি প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমার জানামতে নাসির কাজী কক্সবাজারে দশতলা একটি হোটেল করেছে, গুলশানে একটি ফ্ল্যাট কিনেছে। আমি জেল থেকে আসার পরে নাসিরের সঙ্গে দুই বার কথা হয়েছে।
আমার নামের আত্মসাৎকৃত টাকার ১৬ লাখ টাকা নাসির ডিসি অফিসে জমাও দিয়েছে। পরে আবার যখন তদন্ত আসে তখন নাসিরসহ ওরা আমাকে হুমকি দিয়েছে যেন নাসিরের দুই মামাসহ ওদের কারও নাম না বলি। তখন ওদের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়।
আলো পত্তনদার নামের আরেক মহিলা বলেন, ‘আমাকে দুই লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে নাসির, নাসিরের মামাসহ ওরা আমাকে কয়েকবার মাদারীপুর ডিসি অফিসে নিয়ে যায়। বিভিন্ন কাগজে আমার স্বাক্ষর নেয়। পরে ওরা কত টাকা বিল উত্তোলন করেছে সেটা আমাকে বলেনি। টাকা উত্তোলন শেষে ওরা আমাকে মাত্র ৪৫ হাজার টাকা দিয়েছে।’
শীর্ষ অভিযুক্ত দালাল নাসিরের খোঁজ নিতে তার ভাই মতিউর কাজীকে ফোন দিলে সে জানায়, ‘আমার ভাই ঢাকা আছে নাকি ইন্ডিয়া আছে তা আমার জানা নেই। প্রায় দুই-আড়াই বছর ধরে বাড়িতে আসে না। আর আমি কোনো মামলায় জেলে গিয়েছিলাম তা আমার জানা নেই।’
দ্বিতীয় শীর্ষ অভিযুক্ত দালাল ফরিদ শেখ মোবাইলে বলেন, ‘ডিসি অফিস আরও আগে আমার নামে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। পরে প্রায় পাঁচ মাস আগে মাদারীপুর দুদক অফিস থেকে আমাকে ডেকেছিল। আমি সেখানে গিয়ে তারা যা জানতে চেয়েছেন তার জবাব দিয়েছি। আমি যদি কোনো দুর্নীতি করি তবে তদন্ত করে তা প্রমাণ করেন।
আমার চাকরির সুবাদে আগের অফিসারদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল ছিল। বর্তমান স্যারেরা আগের অফিসারদের সঙ্গে কাদের ভাল সম্পর্ক ছিল সে বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়েই তারা আমাকে সন্দেহ করেছে।’
মাদারীপুর পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের ঘটনায় যারাই জড়িত, যারা রাষ্ট্রের সম্পদ, জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি আমরা অতি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। এটার সঙ্গে যারা জড়িত তারা যত ক্ষমতাশালী হোক আমরা তাদের কোনো ছাড় দেব না। শুধু আইনি পদক্ষেপ না তাদেরকে সামাজিকভাবেও বয়কট করা হবে।
শুধু পুলিশ না দুদকসহ আইন প্রয়োগকারী যত সংস্থা আছে আমরা সবাই মিলে তাদের মূল উৎপাটন করব। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব। এটা ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হবে যেন আর কেউ কখনো সরকারি সম্পদ, সরকারি টাকা আত্মসাৎ করার সাহস দেখাতে না পারে।’
সদ্য বিদায়ী মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেছিলেন, পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, রেলওয়ে প্রকল্পসহ অনেক প্রকল্প আমাদের এখানে বাস্তবায়ন হয়েছে। এ সকল প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ অন্যতম একটি কার্যক্রম। এই ভূমি অধিগ্রহণের কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি এখানে একটি দালালচক্র গড়ে উঠেছে।
এই দালালচক্র পদ্মা সেতু, রেলওয়ের ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের সঙ্গে জড়িত ছিল। সেটা আমরা চিহ্নিত করে ২০ জন দালালের একটি তালিকা তৈরি করেছি। এই ২০ জন দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি পাঠিয়েছি। দুর্নীতি দমন কমিশন এই দালালদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে, তদন্ত করছে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।’
এসডব্লিউএসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ