লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার মতিরহাট থেকে রামগতি উপজেলা পর্যন্ত ৩৭ কিলোমিটার মেঘনা নদীর উপকূল। খরস্রোতা হওয়ায় বর্ষা কিংবা শুষ্ক—দুই মৌসুমেই নদীতে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, ফসলি জমি, রাস্তাঘাটসহ নানা অবকাঠামো। গত ৩০ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কয়েক কিলোমিটার এলাকা।
উত্তাল মেঘনার এ করালগ্রাস থেকে দুই উপজেলার বড়খেরী ও লুধুয়াবাজার এবং কাদিরপণ্ডিতেরহাট এলাকা রক্ষায় সরকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়। ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৮৯ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। গত বছরের শুরুর দিকে নির্মাণকাজ শুরু হলেও ঠিকাদারের গাফিলতি ও কাজের ধীরগতির কারণে প্রতিনিয়তই ভাঙনের কবলে পড়ছে উপকূলবাসী। এবারের বর্ষায় ভাঙন আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে।
মেঘনার তীররক্ষা বাঁধ প্রকল্পের সব প্যাকেজের কাজ একযোগে শুরু না হওয়ায় ভাঙনের মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। আবার বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মাণাধীন প্রকল্পের কাজের মান নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন। কমলনগরের পাটওয়ারীহাট রাস্তার মাথার দক্ষিণাংশের বাঁধের ওপর দিয়ে গত কয়েকদিন জোয়ারের পানি আসা-যাওয়া করছে।
এতে বাঁধ টেকসই ও সুফল মেলা নিয়ে শঙ্কিত নদীতীরের বাসিন্দারা। কাজের ধীরগতির কথা স্বীকার করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্তাব্যক্তিরাও। তবে তাদের যুক্তি হলো, বর্ষার আগে বালি সংকটের কারণে প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো করা যায়নি। এখন নদীর স্রোতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় বাঁধ নির্মাণকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
জানা গেছে, মেঘনার ৩৩ দশমিক ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণের প্রকল্পটি ২০২১ সালের ১ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে পাস হয়। এটি বাস্তবায়নে পুরো প্রকল্পকে ৯৯টি প্যাকেজে ভাগ করে একই বছরের আগস্টে টেন্ডার আহ্বান করা হয়।
এ প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত পাউবোর পক্ষ থেকে ৪৩টি লটের বা সাড়ে ১৩ কিলোমিটার এলাকার জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কমলনগরে আট ও রামগতিতে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। কমলনগর অংশে ২৬টি ও রামগতি অংশে ১৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে। নতুন করে আরো ৩৪টি লটের ওয়ার্ক অর্ডারের কাজ অনুমোদনের অপেক্ষায় বলে জানিয়েছেন পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, উদ্বোধনের পর ১৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করলেও তিন মাসের মাথায় বালি সংকটসহ নানা অজুহাতে তীররক্ষা বাঁধ বন্ধ রাখে। সম্প্রতি চাপের মুখে ঠিকাদাররা কাজ শুরু করলেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই নির্মাণকাজে।
বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়ছে জোয়ারের পানি। প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। এতে কাজের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মাঝে। কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারীহাট রাস্তার মাথার দক্ষিণাংশের নির্মাণাধীন বাঁধের ওপর দিয়ে কয়েকদিন জোয়ারের পানি গড়াচ্ছে।
এতে বাঁধ টেকসই হওয়া নিয়ে শঙ্কিত নদীতীরের বাসিন্দারা। নির্মাণাধীন বাঁধের ওই অংশের দায়িত্বে রয়েছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
এদিকে উপকূলের বাসিন্দারা জানায়, ৩ হাজার ৯০ কোটি টাকার তীররক্ষা বাঁধ প্রকল্পের আগেও রামগতি ও কমলনগর উপজেলার ভাঙন ঠেকাতে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার।
সেনাবাহিনী বাঁধ নির্মাণ করায় রামগতি বাজার ও আলেকজান্ডারের সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকা ভাঙন থেকে রেহাই পায়। তবে একই প্রকল্পে কমলনগর উপজেলার মাতাব্বরহাট এলাকায় ঠিকাদারের মাধ্যমে নির্মিত এক কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের পর আটবার ধসে পড়েছে।
সরজমিনে কমলনগর ও রামগতি উপজেলার কয়েকটি অরক্ষিত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বর্ষায় তীব্র স্রোতে নদীর পাড় ভেঙে পড়ছে। বিলীন হচ্ছে গাছপালা, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ঘরবাড়ি ও দোকানপাট সরিয়ে নিচ্ছে উপকূলের বাসিন্দারা।
দ্রুত সময়ের মধ্যে বাকি লটগুলোর বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু না হলে ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়বে উপকূলবাসী। এতে ভেস্তে যেতে পারে সরকারের ৩ হাজার ৯০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প।
কমলনগরের উপকূলীয় সাংবাদিক সাজ্জাদুর রহমান জানান, রক্ষাবাঁধ নির্মাণকাজের উদ্বোধন হলেও যথাসময়ে একযোগে কাজ শুরু করা হয়নি। উদ্বোধনের পর দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এরপর জিও ব্যাগ ডাম্পিং হচ্ছে।
এখনো অনেক স্থানেই জিও ব্যাগ ডাম্পিংই করা হয়নি। যথাসময়ে রামগতি-কমলনগর তীররক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন না হলে এখানকার মানুষ সুফল থেকে বঞ্চিত হবে। বর্ষা মৌসুম এলেই তীররক্ষা বাঁধ না থাকার কারণে জোয়ারের পানিতে বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হয়। অরক্ষিত হয়ে পড়ে উপকূল। মেঘনাপাড়ের মানুষের সুরক্ষায় দ্রুত নদীর তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করা জরুরি।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সেনাবাহিনীকে দিয়ে নদীর তীররক্ষা বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই কাজ শুরু করা হয়। এখানে শুষ্ক মৌসুমেও নদীভাঙন অব্যাহত ছিল। বর্ষার আগে পর্যাপ্ত পরিমাণ জিও ব্যাগ ডাম্পিং না করায় বর্ষায় কমলনগর-রামগতির বিস্তীর্ণ জনপদ এখন নদীতে বিলীন হওয়ার পথে। নদীর তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজের দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তারা।
কমলনগরের চরলরেঞ্জ ইউনিয়নের নবীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সফিক মাঝি বলেন, ‘পুরান সাহেবের হাট থেকে শুরু করে হাজিগঞ্জ ও নবীগঞ্জ ১০ বছর ধরে ভাঙছে। এবারের বর্ষায়ও ভাঙছে, কিন্তু রক্ষাবাঁধ নির্মাণ বা জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের। তারা এসে এসে শুধু দেখেই যায়।’
নদীপাড়ের তেল ব্যবসায়ী রাশেদ বলেন, ‘হাজিগঞ্জ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার নদী ভেঙেছে। এতে ১৫ বার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সরাতে হয়েছে। এখন আবার ভাঙনের কবলে পড়তে হচ্ছে। অথচ দুই পাশের ইউনিয়নে দুই লটে দুজন ঠিকাদারের লোকজন জিও ব্যাগ ডাম্পিং কাজ করছেন। কিন্তু ভাঙন এলাকায় কারো চোখ পড়ে না।’
এদিকে কমলনগর উপজেলায় চারটি প্যাকেজের কাজ করছেন মেসার্স সালেহ আহম্মদ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার সিরাজুল ইসলাম জানান, সাড়ে ১২ মিটার বাঁধ নির্মাণকাজ পেয়েছেন তারা। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৪ কোটি টাকা।
এরই মধ্যে জিও ব্যাগ ডাম্পিং ও মাটি ভরাট করে বাঁধের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে ব্লক নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। বর্ষায় কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তবে সরকারের উন্নয়ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যথাসময়ের মধ্যে তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৩০০ মিটার কাজের ওয়ার্ক অর্ডার পায় মেসার্স এম আর কনস্ট্রাকশন ও কে কে এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান। চরলরেঞ্জ ইউনিয়নের চরলরেঞ্জ গ্রামে নদীপাড়ের জিও ব্যাগ ডাম্পিং কাজ করছে তারা।
জানতে চাইলে যৌথ প্রতিষ্ঠানের সাব-ঠিকাদার কবির হোসেন জানান, কাজের ওয়ার্ক অর্ডার দেরিতে পাওয়ায় কাজও দেরিতে শুরু করেছেন তিনি। আগামী বছরের জুনের মধ্যে বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ করার কথা রয়েছে তার। বর্ষার শেষে মাটি ফেলে ও ব্লক স্থাপন করে বাঁধ নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হবে। তবে কাজে কোনো গাফিলতি হচ্ছে না।
লক্ষ্মীপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ জানান, রামগতি-কমলনগর মেঘনা নদীর তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে ১৩ কিলোমিটার এলাকায় এখন পর্যন্ত ৪৩টি লটের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে বর্ষাকালীন নদী উত্তাল থাকায় প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে আগামী অর্থবছরের মধ্যে ব্লক নির্মাণকাজসহ অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করা হবে। যেসব স্থানে কার্যাদেশ দেয়া সম্ভব হয়নি তবে বর্ষায় ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে, সেসব স্থান আপৎকালীন জরুরি মেরামতের আওতায় এনে জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে নদীভাঙন রোধের চেষ্টা করা হবে।
এসডব্লিউএসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ