বিগত সরকারের আমলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে নেওয়া ২৫ হাজার কোটি টাকার ২১ প্রকল্প নিয়ে করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভয়াবহ লুটপাটের চিত্র ধরা পড়েছে। এ ছাড়া ওইসব প্রকল্প থেকে এখনো সরকারের প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে বলে জানানো হয়েছে। অনেক প্রকল্পে অসম চুক্তির মাধ্যমে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ চুক্তি করা সঙ্গত হয়নি। এতে সরকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও এর অধীন সংস্থা-দপ্তরগুলোতে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেওয়া ২১টি প্রকল্প মূল্যায়ন করে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি। ৮ আগস্ট ওই কমিটি গঠন করা হয়। যার আহ্বায়ক ছিলেন আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাহবুবুর রহমান। সম্প্রতি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের কাছে প্রতিবেদনের মূল কপি জমা দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনের একটি কপি পেয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। প্রতিবেদনে ২১ প্রকল্পর বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে তিনটি বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রকল্পগুলোতে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি কমিটির পক্ষ থেকে ৫টি সুপারিশ করা হয়েছে।
গুরুত্ব দেওয়া ওই তিনটি বিষয় সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- আর্থিক সাশ্রয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর কর্তৃক গৃহীত প্রকল্পগুলো বেশ কিছু অঙ্গ ও কার্যক্রম প্রকল্পের উদ্দশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং অপ্রয়োজনীয় মর্মে চিহ্নিত করা হয়েছে। চলমান প্রকল্পের এরূপ অঙ্গ ও কার্যক্রম বাদ দেওয়া প্রয়োজন মর্মে সুপারিশ করা হয়েছে।
এসব অপ্রয়োজনীয় অংশ প্রকল্পের স্কোপ থেকে বাদ দিলে সরকারের ৬,৯৮১ কোটি ১৫ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে। অপ্রয়োজনীয় কাজে অপচয়- গৃহীত প্রকল্পের অধীন বাস্তবায়িত হয়েছে, এমন কতিপয় অঙ্গ ও কার্যক্রম প্রকল্পের স্কোপ-এর আওতায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যা প্রকল্পের উদ্দশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এর মধ্যে কতিপয় কার্যক্রম তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বের আওতায় পড়ে না।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক গৃহীত এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে অর্থের অপচয় করা হয়েছে। অতিরিক্ত কাজে অপচয়- বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন ও অন্যান্য নির্মাণ প্রকল্পে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ করায় জমি ক্রয়বাবদ অর্থের অপচয়, অধিক ভূমি উন্নয়ন ব্যয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রশস্ত, অতিরিক্ত উচ্চ ও অতিরিক্ত অবকাঠামো (যথা- আইটি ট্রেনিং সেন্টারে গুদাম নির্মাণ) করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থের অপচয় করা হয়েছে। যেসব পরিকল্পনাধীন নির্মাণ এখনো সম্পন্ন হয়নি তা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রকল্পগুলোর কয়েকটি দুর্বলতা তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সব অধিদপ্তর ও সংস্থা কর্তৃক একই প্রকার কাজ যথা ট্রেনিং সেন্টার, ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্পে নেওয়া হয়েছে। এতে বিসিসি, অধিদপ্তর ও হাইটেক পার্কের কর্মবিভাজন নেই এবং সবাই একই প্রকার কার্যক্রম পরিচালনা করে। যেসব আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে তা পরিচালনার জন্য দক্ষ প্রশিক্ষক ও সহায়ক জনবলের প্রস্তাব রাখা হয়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা চুক্তি না করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করা উন্নয়ন প্রকল্পসংক্রান্ত শৃঙ্খলাপরিপন্থি। এ ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগে সৃষ্ট নেটওয়ার্ক থেকে ইন্ড ইউজার কানেক্টিভিটি প্রদানের ক্ষেত্রে অসম চুক্তির মাধ্যমে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ চুক্তি করা সঙ্গত হয়নি। এতে সরকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ ছাড়া ইডিসি প্রকল্পের মাধ্যমে ইন্ড ইউজার কানেক্টিভিটি দেওয়ার কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে; যা সরকারের দায়িত্ব নয় এবং বাতিল করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে ৫টি সুপারিশ তুলে ধরে বলা হয়েছে- বিভিন্ন প্রকল্প পর্যালোচনা করে কমিটি কর্তৃক চিহ্নিত, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অপ্রয়োজনীয় কার্যক্রম প্রকল্পের স্কোপ থেকে বাদ দেওয়া; প্রকল্পের সৃষ্ট সুবিধা স্থায়ীকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রকল্পের বাস্তবায়ন সমাপ্ত হওয়ার আগে গ্রহণ করা; বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের এখতিয়ারের আওতা সুনিদিষ্ট করা; অডিট আপত্তিগুলো জরুরিভিত্তিতে প্রকল্প সমাপ্তির আগে নিষ্পত্তি করা এবং বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা চুক্তি সম্পাদিত না হলে সহায়তার আওতায় প্রাক্কলিত কাজগুলো প্রকল্পের স্কোপ থেকে বাদ দেওয়া।
এদিকে ওই তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, দেশের জনপরিসরে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে একটি ভয়াবহ লুটপাট ও অপব্যবস্থাপনার খাত হিসেবে পরিচিত করিয়ে দিয়ে গেছে। দেশের গণমাধ্যমে এসব নিয়ে বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী অপকর্মে দেশের ডিজিটাল ইকোনমি এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতিও নাজুক হয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ