সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার পূরণের লক্ষ্যে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে অনুমোদনের জন্য আজ একনেক সভায় উত্থাপন করা হচ্ছে বহুল আলোচিত ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পটি। শহরের মতো গ্রামেও আবাসনের জন্য ফ্ল্যাট সুবিধা, ইউনিয়নে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, পানি ও স্যানিটেশন এবং টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। প্রাথমিকভাবে ১৫টি ইউনিয়নে পাইলট প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় করবে সরকার। পর্যায়ক্রমে তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে। তবে প্রকল্পটিতে বহুমুখী কাজের আগে গ্রামভিত্তিক কোনো মাস্টারপ্ল্যানই করা হয়নি। তাছাড়া গ্রামে ফ্ল্যাট তৈরির প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একেএম ফজলুল হক বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান হবে। ধরেন, দুটি গ্রামে আমরা দেখব প্রকল্পটি কীভাবে কাজ করে। প্রস্তাবিত ব্যয় ও ত্রুটি-বিচ্যুতির আলোকে মাস্টারপ্ল্যান হলে সেটা আরো কার্যকর হবে। ইউনিয়নের ভিন্নতার আলোকে কমন কিছু ফিচার নিয়ে এটা করা হবে।’ প্রকল্পটি পর্যায়ক্রমে সারা দেশে বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানান এটি অনুমোদনের দায়িত্বে থাকা এ সচিব।
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) তথ্যমতে, প্রাথমিকভাবে তিনটি গ্রামে ৬৮টি চারতলা আবাসন ভবন নির্মাণ করা হবে। জমির প্রকৃত মালিকদের মধ্যে যারা ১০ শতাংশ অগ্রিম অর্থ দেবেন তাদের কাছে ৬১৬টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়া হবে। বরাদ্দের বিষয়ে একটি সমীক্ষাও চালানো হয়েছে। জমির মালিকানার আলোকে ভবনের সামনে কৃষিকাজের জন্য জমি বরাদ্দ রাখা হবে। তবে কত কিস্তিতে কত টাকা জমা দিতে হবে তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামতের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এ আবাসন সুবিধা তৈরি করতে ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
গ্রামের নাগরিক সুবিধা দেয়া আর আবাসন সম্প্রসারণ দুটি আলাদা বিষয় বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। গ্রামে গ্রামে আবাসিক ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্রামে কেন ফ্ল্যাট তৈরি হবে? গ্রামে এটার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা সেটা প্রথম প্রশ্ন। প্রকল্পের নামটাই একটা সমস্যা। গ্রাম তো আর শহর হবে না। ফ্ল্যাট তৈরি হলে তো নগর হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে আমাদের গ্রামগুলোয় এভাবে চারতলা ফ্ল্যাট থাকবে, আমরা সেটা চাই কিনা? অনেক আলোচনার পরও এ প্রকল্পে যদি এমন ব্যত্যয় হয় তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ সঠিক পথে যাচ্ছে কিনা সেটি একটি বড় প্রশ্ন।’ প্রকল্প ব্যয় বাড়াতেই এমন আয়োজন কিনা সে প্রশ্নও রাখেন এ নগর পরিকল্পাবিদ।
আগামী জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে তিন বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে এলজিইডি ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ১৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৫৭ কিলোমিটার সড়ক, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ। ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হবে ২৩টি গ্রোথ সেন্টার। পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনে ব্যয় হবে ৪৩ কোটি টাকা। ২৭টি হাটবাজার স্থাপনে ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পাঁচটি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হবে ৬২ কোটি টাকা। ২৩ কোটি টাকায় ১৪টি খাল ও পুকুর খনন করা হবে। খেলার মাঠ ও সবুজায়নে ২৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। গ্রামের সড়কে বনায়নের জন্য রাখা হয়েছে ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। আর ৯৫০টি সড়কবাতির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে সাড়ে ৯ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির মাধ্যমে ৫ হাজার ১০০ বেকার তরুণকে জীবনমান উন্নয়নে পেশাভিত্তিক হস্তশিল্প ও কৃষি প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ কোটি টাকা। গ্রামগুলোর ব্র্যান্ডিং করার জন্যও ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া কর্মকর্তাদের জন্য অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণে ২০ লাখ ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে বিদেশে যেতে প্রতিবেশী দেশকে প্রাধান্য দিতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন। যদিও বিদেশ ভ্রমণকে আরো বেশি নিরুৎসাহিত করার কথা বলেছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সংসদ চলমান থাকায় অবশ্য এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
ডিপিপিতে এ বিষয়ে বলা হয়, শহরের সুবিধা গ্রামে ছড়িয়ে দিতে এলজিইডি ও ডিপিএইচ যৌথভাবে একটি কারিগরি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেটির আলোকে আটটি সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। আর এসব সুবিধা বাড়াতে ৩৬টি সমীক্ষা ও ৩০টি গাইডলাইন তৈরির জন্য তথ্য সংগ্রহের সুপারিশ চূড়ান্ত করা হয়। এসব নীতিমালা ও গাইডলাইন তৈরি এবং পরীক্ষামূলক প্রয়োগে ১৫টি ইউনিয়নে পাইলট প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে আট বিভাগের আট ইউনিয়ন এবং বিশেষ এলাকা হিসেবে হাওর, পাহাড় ও চরাঞ্চল থেকে সাতটি ইউনিয়ন বাছাই করা হয়।
প্রকল্পটির বিষয়ে গত মে মাসে পরিকল্পনা কমিশনে মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। প্রকল্পটির মাধ্যমে জনগণকে কী কী সুবিধা দেয়া হবে তা সুস্পষ্টভাবে জানতে চাওয়া হয় সেখানে। একই সঙ্গে প্রতিটি গ্রামে ২৫ শতাংশ জায়গায় বনায়ন নিশ্চিত করতে নিদের্শনা দেয়া হয়। সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য আগে প্রকল্প এলাকার মাস্টারপ্ল্যান করার নির্দেশ দেয়া হয় ওই সভায়। এলজিইডি তখন জানায়, দ্রুতই এ বিষয়ে মাস্টারপ্ল্যান করা হবে।
বৈঠকে আরো জানতে চাওয়া হয়, ফ্ল্যাট নিতে কিস্তির পরিমাণ ও সরকারি কোষাগারে কত রাখা হবে? ফ্ল্যাট বণ্টন ও প্রশিক্ষণের বিষয়েও জানতে চায় কমিশন। এছাড়া প্রশিক্ষণ, জরিপ, ব্র্যান্ডিং, কম্পিউটারসামগ্রীসহ বেশকিছু খাতে বরাদ্দ কমাতেও নির্দেশ দেয়া হয়।
প্রকল্পটি নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম অবশ্য বলেন, ‘দেশে যে পরিমাণ দুর্নীতির প্রকোপ, সে অবস্থায় চারতলা ভবন নির্মাণে সরকারের উদ্দেশ্য হাসিল হবে না।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৪৫
আপনার মতামত জানানঃ