চিনিশিল্প দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু সরকার এখন এই শিল্পকে আরও পেছনে ঠেলে দিতে চাইছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টি চিনিকলের (পঞ্চগড়, সেতাবগঞ্জ, শ্যামপুর, রংপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া) উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। হঠাৎ উৎপাদন বন্ধের ঘোষণায় আখচাষী ও চিনিকল শ্রমিকরা পড়েছেন অসহায় অবস্থায়।
সরকার পাটশিল্পের মতোই চিনিকলের ক্ষেত্রেও লোকসানের দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু গবেষকদের একাংশের অভিমত, সরকার লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছে বটে, তবে শ্রমিক ও চাষীদের প্রতি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে না। এর ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক ও কৃষকদের। তাছাড়া কৃষি পরিবেশবান্ধব এমন একটি শিল্পধারা দুর্বল হয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও দশ, সকলেই। শ্রমিকপক্ষ বলছে, সরকার সুরক্ষা দেয়ার কথা থাকলেও এখন সরকারের ভেতরের একটি অংশের বিরুদ্ধেই তাদের লড়তে হচ্ছে।
এই করোনাকালে যেখানে মজুরি ও কর্মসংস্থান বিরাট চাপের মুখে এ অবস্থায় সরকার কোন হিসাবে কারখানা বন্ধ করছে, এমন প্রশ্ন উঠেছে সঙ্গত কারণেই। চিনিশিল্পের আধুনিকায়নের সুযোগ ও প্রস্তাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকার সে পথ না মাড়িয়ে কারখানা বন্ধের তরিকাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষে সওয়ালকারী স্বনামখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা এ প্রশ্নে সরকারের ভূমিকাকে জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের। দেশের মানুষের বার্ষিক প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদার বিপরীতে কর্পোরেশনের অধীনস্থ ১৫টি চালু চিনিকলের বার্ষিক ২ লাখ ১০ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন ক্ষমতা পথ চলা দেশের অন্যতম ভারী শিল্পটির। পথচলা শুরুর পর ৪ দশকের বেশি সময়ে মধ্যে মাত্র ১৬টি মাড়াই মৌসুমে লাভের মুখ দেখেছে চিনি শিল্প।
লোকসানের কারণ হিসেবে সরকারের তরফে উৎপাদন খরচ, চিনি বিক্রি না হওয়া ও দুর্নীতিকে দায়ী করা হচ্ছে। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। মূলত পুরনো কারখানা ও জনবল জটিলতায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। একইভাবে দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চিনি উৎপাদনের পরও বিদেশ থেকে ‘র’ সুগার এনে রিফাইনারি স্থাপনের মাধ্যমে সাদা চিনির কারণে শিল্পটি অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। কিন্তু বাজার সংকুচিত হলেও চিনির বিকল্প বাজার তৈরির উদযোগ নেয়া হয়নি। যদিও চিনিকলের চিনি রিফাইন করে সাদা চিনিতে রূপান্তর, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে দেশি চিনিকে ব্যবহার উপযোগী করা ও চিনিনির্ভর খাদ্যপণ্যে দেশিয় চিনির ব্যবহার বাড়ানো হয়নি। এমনকি চাহিদা থাকার পরও দেশি লাল চিনির ব্র্যান্ডিংও করা হয়নি।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর সংকটের বড় কারণ ঋণ ও তার সুদ। রংপুর চিনিকলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে গত মৌসুমে খরচ হয়েছে ১৮৬ টাকা ২৪পয়সা। এই চিনিকলের ১৫৮ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ আছে। এর সুদ হিসাব করলে প্রতিকেজি চিনি উৎপাদনের খরচ দাঁড়ায় ৩১১ টাকা ৯৭ পয়সা। সেই চিনি বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫৩ টাকা ৩৫ পয়সা কেজি দরে। সরকার এই সুদ মওকুফ করলে চিনি কলটির লোকসান অর্ধেক কমে যেত।
সুদ মওকুফ এবং সেইসঙ্গে প্রয়োজন চিনি উৎপাদন ব্যবস্থা আধুনিক করে উৎপাদনের ব্যয় কমিয়ে আনা। কিন্তু তা না করে সুদের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। পঞ্চগড় চিনিকলে গত মৌসুমে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ছিল ৩০২ টাকা (সুদসহ)। একইভাবে প্রতি কেজি উৎপাদনে কুষ্টিয়ায় ২৭৩, শ্যামপুরে ২৬২, সেতাবগঞ্জে ২৪৯ এবং পাবনায় ১৭৮ টাকা ব্যয় হয়েছে। আর বিক্রি হয়েছে ৫৩ থেকে ৫৭ টাকা কেজি দরে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় চিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা, দায়িত্বশীলদের অদূরদর্শীতা, চিনিকলগুলোর সম্পদের যথাযথ ব্যবহার না করা ও সর্বস্তরে দূর্নীতির কারণেই চিনিশিল্প পিছিয়ে পড়েছে। এ শিল্পকে আধুনিকায়নের জন্য সময়োপযোগী পরিকল্পনার মাধ্যমে লাভজনক করার কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। যদিও শেষ মুহুর্তে এসে লোকাসানের দায় কৌশলে শ্রমিকদের ওপরেই চাপানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে, স্মারকলিপি পাঠিয়ে চিনিকল সংকটের বাস্তব কারণ ও তার সমাধানের সরল পথ সম্বন্ধে সরকারকে অবহিত করেছেন।
গবেষকরা মনে করেন, সারা দেশের ১৫টি চিনিকল ব্যাপক সম্ভাবনা থাকার পরও নির্দিষ্ট কিছু কারণেই লোকসানের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারছে না। আখ সঙ্কট, অনিয়ম, দুর্নীতি আর কারখানার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বাড়ছে চিনির উৎপাদন খরচ। অন্যদিকে প্রযোগিতাপূর্ণ বাজারে কমছে চিনির মূল্য। এসব কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে শুধু টিকে থাকার স্বার্থে চলছে আখ মাড়াই কার্যক্রম। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, চিনি শিল্পের বিপুল পরিমাণ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করে চিনিকলে সম্পদের বহুমুখী ব্যবহার, অনিয়ম দুর্নীতি ও আখচাষী হয়রানি রোধ, আখের বিকল্প কাঁচামাল, চিনির উৎপাদন খরচ কমানো এবং উৎপাদন হার বৃদ্ধি করা গেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারে উত্তর জনপদের আলোচিত শিল্পটি।
আলাপকালে এই প্রতিনিধিকে শ্যামপুর চিনিকলের আখচাষী ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন বলেন, “সরকারের অদূরদর্শীতার কারণেই চিনিশিল্প লোকসান গুণছে। বন্ধ করার বিষয়টি কালো চাদরে ঢাকা। যদি আধুনিকায়নও করা হয় সেটা মিল চালু রেখেও করা সম্ভব ছিল। মিল বন্ধের ঘোষণা আখচাষীরাও ক্ষতিগ্রস্থ হব। তাই সরকারকে মিল বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে।”
এদিকে চিনিকলগুলোকে আধুনিকায়নের জন্য বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় বেশকিছু উদ্যোগের কথা গত এক দশকে বিএসএফআইসির তরফে বলা হয়েছে। এর মধ্যে কারখানাগুলোর বিএমআরই, আখের বিকল্প কাঁচামাল হিসেবে সুগার বিটভিত্তিক প্ল্যান্ট স্থাপন, বয়লার থেকে কয়লা বা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, বর্জ্য থেকে জৈবসার-রেক্টিফায়েড স্পিরিট উৎপাদন ও চিনি রিফাইনারি স্থাপন বিষয়গুলো ছিল। এজন্য পরীক্ষামূলক পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বাংলাদেশ আখচাষী ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “লোকসানের কথা বলে চিনিকল বন্ধ বা বিক্রির ষড়যন্ত্র সঠিক নয়। এতে শ্রমিক ও আখচাষীসহ কয়েক কোটি লোক ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই চিনিকলগুলোকে লাভজনক করার যে পদ্ধতি আছে সেগুলো নিয়ে চিনিকলগুলোকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।”
শ্যামপুর, রংপুর, পঞ্চগড়, পাবনা ও কুষ্টিয়াসহ ছয়টি চিনিকল বন্ধের ঘোষণায় প্রায় এক মাস ধরে আন্দোলন চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশ প্রশাসনের তরফে আন্দোলনকারীদের হুমকি দেয়া হচ্ছে বলেও তথ্য মিলেছে। সেইসঙ্গে আধুনিকায়নের নামে বন্ধ চিনিকলগুলো দেশীয় বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের হাতে তুলে দেয়া হতে পারে, এমন গুঞ্জনও ডালপালা মেলছে। সর্বশেষ চিনিশিল্প করপোরেশনও তিনটি দেশের সাথে আলোচনার কথা জানিয়েছে।
তবে বন্ধ হওয়া কারখানার সঙ্গে জড়িত চিনিকল শ্রমিক, আখচাষী মিলিয়ে এই শিল্প ও কৃষিধারার ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখের মতো। ধারণা কয়রা হচ্ছে, সরাসরি ক্ষতির শিকার এই বিপুল জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশিয় শিল্প ও লাল চিনির উৎস নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে সারা দেশের মানুষই। স্বনির্ভর জাতীয় শিল্প, পরিবেশবান্ধব, জনগণের জীবিকা ও স্বাস্থ্যবান্ধব চিনিশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে দেশব্যাপী জনমত গড়ে উঠছে।
চিনিশিল্প রক্ষায় পরিবেশবিদ ও অর্থনীতিবিদরাও হয়ে উঠছেন সোচ্চার। আন্দোলনকারী চিনিকল শ্রমিক ও ক্ষতিগ্রস্ত চাষীরা দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলছেন, স্থানীয় কৃষি, পরিবেশ ও শ্রমিকবান্ধব চিনিশিল্প বন্ধ করে তা বেসরকারি পর্যায়ে মুনাফার কারবারিদের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা তারা প্রতিহত করবেনই। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা চিনি শিল্পের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা ও আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়ায় এই শিল্পকে উৎপাদনের মূল ধারায় ধরে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। জাতীয় স্বার্থ ও শ্রমিক-কৃষকের প্রতি আরো দায়িত্বশীল হতে তারা সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
ছবি ও লেখা : পলাশ শরিফ, রংপুর থেকে ফিরে।
এসডাব্লিউ/এসএন/এসআইপি/আরা/২০৫০
আপনার মতামত জানানঃ