গত জুন মাসে টাঙ্গাইলের সখীপুরের গজারিয়া ইউনিয়নে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও পৌরসভা নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইভিএমে ধীরগতির ভোটের কারণে ভোটাররা ভোগান্তিতে পড়েছেন। আঙুলের ছাপ না মেলায় বিপাকে পড়তে হয়েছে অনেককে।
নির্বাচনকে ঘিরে সবথেকে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে ইভিএম। ইতিমধ্যে ৩৫ টি রাজনৈতিক দল ইভিএম পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে। তবে সন্দেহ, সংশয়, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা এবং বিতর্ক থাকলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট গ্রহণ চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) আগামী নির্বাচন করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের এমন মনোভাবের সঙ্গে প্রায় প্রশ্নহীনভাবে একমত পোষণ করেছে মাত্র তিনটি দল। দল তিনটি হলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি। অন্যরা ইভিএম নিয়ে কমবেশি সংশয়–সন্দেহ, আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাসের কথা বলেছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন ইভিএমে করার জন্য ক্ষমতাসীন দল ও সরকার কতটা উৎসাহী, তা কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত আলোচনার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে পরিষ্কার। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইভিএম-বিষয়ক তৃতীয় ও শেষ ধাপের মতবিনিময় সভার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ৩০০ আসনেই ইভিএম চাই। মন থেকে চাই, চেতনা থেকে চাই।’ বিষয়টিতে দলের অবস্থান যে শক্ত, তা বোঝাতে তিনি বলেন, ‘আমরা গত নির্বাচনের সময় কমিশনে বলেছি, আমাদের দলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমাদের পার্টির স্ট্যান্ড হচ্ছে, দিস ইজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার—আমরা ইভিএম পদ্ধতির পক্ষে, রাখঢাক করে কোনো লাভ নেই।’
ইভিএমের বিরোধিতা
ইসির সঙ্গে গতকালের সভায় ইভিএমের সরাসরি বিরোধিতা করে বক্তব্য দিয়েছে জাসদ, গণফোরামসহ চারটি রাজনৈতিক দল।
গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আইনজীবী সুরাইয়া বেগম সভায় বলেন, ইভিএম একটি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর মাধ্যমে একজন ভোটার তার পছন্দের প্রতীকে ভোট দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারে না। তা ছাড়া ইভিএমে খুব সহজেই জালিয়াতির মাধ্যমে ফলাফল পরিবর্তন করার অনেক ‘মেকানিজম’ রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) স্থায়ী কমিটির সদস্য মোশারফ হোসেন বলেন, ইভিএমে জাতীয় নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, এই পদ্ধতি এখনো সব মানুষের কাছে পরিচিত নয়।
ইভিএমের ওপর আস্থা নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (বাংলাদেশ ন্যাপ) মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সন্দেহ ও অবিশ্বাস আছে। দেশের জনগণ মনে করে, ইভিএম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘ভোট চুরির বিশ্বস্ত যন্ত্র’।
প্রযুক্তি হিসেবে ইভিএম উন্নত পদ্ধতি হলেও মানুষ এই যন্ত্র ব্যবহার করে ভোট দিতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন তোলেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব আব্দুল মান্নান। সারা দেশের সব ভোটকেন্দ্রের সব বুথে ইভিএম সরবরাহ ও তা নিয়ন্ত্রণ ইসি করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও নিজের সংশয়ের কথা সভায় তিনি তুলে ধরেন।
ইভিএম নিয়ে আলোচনার জন্য নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অংশ নেয়নি মোট ১১টি দল। তারা হলো বিএনপি, সিপিবি, বাসদ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)।
বিএনপিকে দ্বিতীয় ধাপে ২১ জুন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে দলটি অংশ নেবে না বলে আগেই বলেছিল।
ইভিএম নিয়ে প্রথম ধাপে জাতীয় পার্টিসহ ১৩টি দলের (অংশ নেয়নি তিনটি দল) সঙ্গে ১৯ জুন আলোচনা করে ইসি। সভায় জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে।
অন্যদিকে সভা বর্জন করে ইসিকে দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বলেছে, ইভিএম এখনো বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেনি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে ভোটদান পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে। তাই আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।
আর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সভা বর্জনের কারণ হিসেবে ইসিকে চিঠি দিয়ে বলেছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না, তার কিছু লক্ষণ ১৫ জুন অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে।
কী করবে নির্বাচন কমিশন?
আমাদের অসহিষ্ণু ও বৈরিতাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে নির্বাচন পরিচালনার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তাদের প্রায় সবাই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
এমনকি চরম ব্যর্থতা ও খোলামেলাভাবে দলীয় পক্ষপাতের জন্য বিপুলভাবে সমালোচিত সদ্য সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার খান মোহাম্মদ নূরুল হুদাও এখন বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া হলে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনেরও প্রয়োজন নেই। প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্মতি বা সমঝোতা ছাড়া ইভিএমের প্রবর্তন করে বিতর্কের জন্ম দেওয়া সিইসি নূরুল হুদাই সম্ভবত একমাত্র সাবেক কমিশনপ্রধান, যিনি আগামী জাতীয় নির্বাচন ইভিএমে অনুষ্ঠানের পক্ষে কথা বলেছেন।
ইভিএমের পক্ষে যে রাজনৈতিক মতৈক্য নেই, সে কথা স্বীকার করে নিয়ে বর্তমান সিইসি আউয়াল বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না, তা পর্যালোচনা করবে ইসি। ইসির সামর্থ্য কতটা রয়েছে, সেটা দেখা হবে। আদৌ ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না বা সম্পূর্ণ কিংবা অর্ধেক আসনে ব্যবহার হবে কি না, সে বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে।’
তার এ বক্তব্য আপাতদৃশ্যে সরল ও যৌক্তিক মনে হলেও কমিশনের সিদ্ধান্ত বদলের সাম্প্রতিক নজিরগুলো সন্দেহ জাগায়। ক্ষমতাসীন দল ও সরকার চাইলে তা নাকচ করার নৈতিক মনোবল ও সাহস তারা দেখাতে পারবেন, এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। ইভিএম কারা চায় এবং কেন, এ প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা। কোনো রাজনৈতিক দল নিজেদের সুবিধা ছাড়া নিঃস্বার্থভাবে নির্বাচনে কোনো পরিবর্তন চাইতে পারে—এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য?
আরেকটি প্রশ্ন হলো, সিইসির কথামতো যে সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে, তা নিয়ে এত ঘটা করে আলোচনা বা মেশিন পরীক্ষার আয়োজনই কেন অগ্রাধিকার পেল? কমিশনের তো বরং অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা সামগ্রিকভাবে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যের সম্ভাব্য দিকগুলো খতিয়ে দেখা ও সেই মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য সব দলকে উৎসাহিত করা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ