সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার দেওয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনিয়ম এবং সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে। তিনি আদালতের কাছে স্বীকার করেন, ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে ভোট কারচুপি করেছে এবং এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় গোটা নির্বাচনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এমন স্বীকারোক্তি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় গভীর আস্থাহীনতা এবং প্রশাসনিক কাঠামোর ভয়াবহ অপব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘দিনের ভোট রাতে’ হওয়ার অভিযোগ বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত ছিল। এবার সেই অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে জবানবন্দিতে নূরুল হুদা জানিয়েছেন, নির্বাচনের দিন ভোররাতেই অনেক কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ভর্তি করে রাখা হয়েছিল। শতভাগ ভোট পড়ার মতো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিও দেখা গেছে, যা তিনি নির্বাচন শেষে ফলাফল দেখে বুঝতে পারেন। তিনি বলেন, তখন তিনি ও তার কমিশনের সদস্যরা পুরোপুরি অন্ধকারে ছিলেন এবং প্রশাসন, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাংশ সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাসীন দলের নির্দেশনায় কাজ করেছিল।
নূরুল হুদার বক্তব্য অনুযায়ী, রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ প্রশাসন ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে নির্বাচনী অনিয়মে অংশ নিয়েছেন। বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই এবং ডিজিএফআইয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ভোট নিয়ন্ত্রণের প্রধান ভূমিকা পালন করেন বলে তার ধারণা। তিনি আরও বলেন, পুলিশ বাহিনীও তার সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি, বরং তারা বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে ভোটের মাঠ ফাঁকা করেছিল। যদিও আদালতে এই জবানবন্দির বিষয়ে তার আইনজীবীরা বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি।
জবানবন্দিতে নূরুল হুদা নিজের ভাগিনা এস এম শাহজাদার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হওয়াকেও স্বীকার করেছেন। যদিও তিনি দাবি করেন, মনোনয়ন প্রাপ্তিতে তার কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে তিনি বুঝতে পারেন, ভাগিনার প্রভাব ও তার পরিচয়ের কারণে কিছু সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে।
এদিকে এই জবানবন্দি সামনে আসার পর সাবেক দুই গোয়েন্দা প্রধান—ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) সাইফুল আবেদিন ও এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) টি এম জুবায়েরের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে এবং তাঁদের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
নূরুল হুদা দাবি করেন, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না পাওয়ার একটি কারণ হতে পারে, অনেক কর্মকর্তা টাকা পেয়ে চুপ থেকেছেন, কিংবা রাজনৈতিক দলের প্রভাবের কারণে অনেকে ভয়ে মুখ খোলেননি। তিনি বলেন, যারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, তারাই ছিল এই অনিয়মের মূল উপভোক্তা।
অন্যদিকে, ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেছেন, যদি নূরুল হুদা অনিয়মের তথ্য আগে থেকেই জানতেন, তাহলে তার দায়িত্ব ছিল যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। তিনি তা না করে বরং ভোট কারচুপিকে বৈধতা দিয়েছেন এবং শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন।
এই জবানবন্দি এমন এক সময়ে সামনে এলো, যখন ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে এবং অন্তর্বর্তী সরকার বিতর্কিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের তদন্তে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির সদস্য মো. আবদুল আলীম বলেন, নূরুল হুদা যদি পদত্যাগ করতেন, তাহলে তিনি হয়তো নায়ক হিসেবে জাতির সামনে আসতেন, কিন্তু তা না করে তিনি তৎকালীন সরকারকে সহযোগিতা করে গেছেন।
বাংলাদেশে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক থাকলেও, এবারই প্রথম সাবেক একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার সরাসরি আদালতে স্বীকার করেছেন যে, নির্বাচন কমিশনকে পাশ কাটিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারি দলের সরাসরি প্রভাবে জাতীয় নির্বাচনে ভয়াবহ অনিয়ম ও কারচুপি ঘটানো হয়েছিল।
নূরুল হুদার এই জবানবন্দি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে বড় ধরনের চিড় ধরিয়েছে। এটি শুধু ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়কেই সামনে আনেনি, বরং ভবিষ্যতের জন্য গণতন্ত্রের পথে গুরুতর প্রশ্নও তুলে দিয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ