ইন্টারনেটে অবারিত নজরদারিতে আমাদের প্রায় কোনো তথ্যই আজ গোপন থাকছে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক, অ্যাপস, ই-মেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন- ইন্টারনেট সংশ্নিষ্ট সব সেবাই আমাদের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখছে। জেনে অথবা অজান্তে আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের ট্র্যাকিংয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছি।
ডিজিটাল পরিসরে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে আছে। আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিদ্যমান হুমকি মোকাবিলা ও ইন্টারনেট স্বাধীনতা প্রসারের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ইন্টারনেট স্বাধীনতা উদ্যোগ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেছে।
দেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রধান হুমকিগুলো চিহ্নিত করতে অংশীজনদের নিয়ে কর্মশালা করেছে বাংলাদেশ ইন্টারনেট স্বাধীনতা উদ্যোগ ওয়ার্কিং গ্রুপ। কর্মশালার আলোচনায় উঠে এসেছে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রধান হুমকির একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় সরকারি কর্মকর্তা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধি, কূটনীতিক, জাতিসংঘের প্রতিনিধি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অধিকারকর্মীসহ ৩৫ জন অংশ নেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন এ কর্মশালা আয়োজনে সহযোগিতা করে।
এতে বলা হয়, দেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রধান হুমকিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো মোকাবিলায় তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন হুমকি, হুমকির উৎস ও কারণ, ক্ষতিগ্রস্ত অংশীজন প্রভৃতি চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া চিহ্নিত প্রধান হুমকিগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, এই আইন সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ডিজিটাল ডিভাইস ও প্ল্যাটফরম ব্যবহার বিষয়ে অসচেতনতা, সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি প্রণয়নে অস্বচ্ছতা ইত্যাদি। এসব হুমকি মোকাবিলায় সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
কর্মশালা পরিচালনা করেন ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ ল’য়ের সিনিয়র লেকচারার মো. সাইমুম রেজা তালুকদার। ওয়ার্কিং গ্রুপের পক্ষে তিনি ‘ইন্টারনেট স্বাধীনতা: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য ও বাংলাদেশ টেলিকম রিপোর্টার্স নেটওয়ার্কের সভাপতি রাশেদ মেহেদী বলেন, ‘ইন্টারনেট স্বাধীনতা ও ডিজিটাল অধিকার নিশ্চিত করতে হলে ইন্টারনেটে সবার প্রবেশগম্যতা ও সংশ্লিষ্ট নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ডিজিটাল পরিসরে ব্যবহারকারীকে ব্যক্তিগতভাবে সচেতন ও দায়িত্বশীল আচরণও করতে হবে।
আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আর নাগরিকের ডিজিটাল স্বাধীনতা সমান গুরুত্বপূর্ণ। দেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতা ও ডিজিটাল অধিকারের বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা কম। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা ইন্টারনেট স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন হুমকি, হুমকির উৎস ও কারণ, ক্ষতিগ্রস্ত অংশীজন প্রভৃতি চিহ্নিত করেন। চিহ্নিত প্রধান হুমকিগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, এই আইন সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ডিজিটাল ডিভাইস ও প্ল্যাটফরম ব্যবহার বিষয়ে অসচেতনতা, সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি প্রণয়নে অস্বচ্ছতা ইত্যাদি।
‘ইন্টারনেট স্বাধীনতা ও ডিজিটাল অধিকার নিশ্চিত করতে হলে ইন্টারনেটে সবার প্রবেশগম্যতা ও সংশ্লিষ্ট নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ডিজিটাল পরিসরে ব্যবহারকারীকে ব্যক্তিগতভাবে সচেতন ও দায়িত্বশীল আচরণও করতে হবে।
এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০২১ উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ওয়ার্কিং গ্রুপের ঘোষণা করা হয়।
আর্টিকেল নাইনটিনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই গ্রুপ দেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ধারণাকে উৎসাহিত ও অগ্রসর করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সরকারি নীতি ও আইনের সংস্কারের জন্য সুপারিশ প্রদানের মাধ্যমে কাজ করবে। এ জন্য ওয়ার্কিং গ্রুপ বিদ্যমান জাতীয় আইনি কাঠামোর বিশ্লেষণ, কৌশলগত অ্যাডভোকেসি এবং ক্যাম্পেইনও পরিচালনা করবে।
আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ও ওয়ার্কিং গ্রুপের অন্যতম সদস্য ফারুখ ফয়সল বলেন, ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্বিক লক্ষ্য হলো নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে দেশে অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রসার এবং তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করা। গ্রুপটি ইন্টারনেট স্বাধীনতার প্রসারে কাজ করে এমন নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রাসঙ্গিক নীতি প্রণয়নে সরকারকে সহযোগিতা করবে। এ ছাড়া ডিজিটাল অধিকার বাস্তবায়নে সহায়ক আইনি ও নীতিকাঠামোর প্রতি সমর্থন এবং অনলাইন স্বাধীনতার প্রতি হুমকির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখবে।
সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক সভা ও ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে গ্রুপটি গঠন করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, প্রযুক্তিবিদ, সাইবার বিশেষজ্ঞ, ডিজিটাল অধিকারকর্মী, শিক্ষার্থী, জেন্ডার অ্যাকটিভিস্ট এবং যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধি যুক্ত ছিলেন।
নবগঠিত এই ওয়ার্কিং গ্রুপের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ ডিজিটাল পরিসরে ইন্টারনেটভিত্তিক নাগরিক পরিষেবার বিস্তারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এটি বহু মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। অথচ একই সময়ে সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকার যেমন—মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্য জানার অধিকার এবং ডিজিটাল পরিসরে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। উন্নত বিশ্বে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা একটি স্পর্শকাতর ইস্যু। বাংলাদেশেও মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের মতো চরম নৈতিক অপরাধকে প্রতিহত করার জন্য আইনি ব্যবস্থা থাকা জরুরি। কেউ ইচ্ছা করলেই যাতে আরেক নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে না পারে সেজন্যই শক্ত আইন থাকা উচিত। আইন ব্যক্তির পক্ষে তার অধিকার সংরক্ষণে দায়িত্ব পালন করে। এর সঙ্গে সঙ্গে আইন মেনে চলার জন্য জনসচেতনতাও প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা ব্যক্তি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্রচার ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কীভাবে বজায় থাকবে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের সমালোচনা করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এই আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের যেসব ঘটনা ঘটছে, পরিষ্কারভাবে তা গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
তারা বলেন, যে নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সে আইন নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে— এ আইন কার জন্য করা হয়েছে? আইন তো তৈরি করা হয় সাধারণ জনগণের জন্য। এই আইন আসলে কার নিরাপত্তা দিচ্ছে? এ আইনে যারা বাদী হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, এমপি, মন্ত্রী ও প্রশাসনের লোকজন। আর যারা আইনের শিকার হয়েছেন তারা সাংবাদিক, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের সাহস গড়ে তোলেন একজন লেখক, সাহিত্য, অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক। তারা যেন মুক্তভাবে কথা বলতে পারে সেজন্য তাদের সমর্থন করুন। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি নিপীড়নমূলক আইন গণতন্ত্রের দেশে থাকতে পারে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ