জিএসএম প্রযুক্তি ব্যবহারের পর থেকে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট ও ভয়েস কল। জিএসএম প্রযুক্তি ব্যবহারের পর থেকে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট ও ভয়েস কল। বর্তমানে দেশের ইন্টারনেট ও ভয়েস কলে আধিপত্য রয়েছে মূলত তিন সেলফোন অপারেটরের—গ্রামীণফোন লিমিটেড, রবি আজিয়াটা লিমিটেড ও বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস। কিন্তু এ তিন অপারেটরের নানা প্যাকেজ নিয়ে প্রায়ই বিভ্রান্তিতে পড়তে হয় বলে অভিযোগ তুলেছেন ভোক্তারা।
তারা বলছেন, এত এত প্যাকেজের ভেতর কোনটি তাদের জন্য উপযুক্ত, তা বাছাই করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কোনো প্যাকেজে এক গিগাবাইট ডাটা কিনতে তাদের খরচ পড়ে ৬ টাকা, কোনো প্যাকেজে পড়ে প্রায় ৫০ টাকা। ভয়েস কলের ক্ষেত্রেও রয়েছে একই ধরনের তারতম্য। আবার এক অপারেটরের প্যাকেজের সঙ্গে আরেক অপারেটরের সামঞ্জস্য নেই।
এসব বিভ্রান্তির ব্যাপারে অপারেটরদের ভাষ্য হলো যেকোনো পণ্য বা সেবার মতো এ খাতেও দাম নির্ভর করে পরিমাণ (ভলিউম), মান ও মেয়াদের ওপর। গ্রাহকরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ প্যাকেজ নির্বাচন করে থাকেন। এছাড়া ভয়েস অথবা ডাটার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় বলেও দাবি অপারেটরদের।
গ্রামীণফোনের প্যাকেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাদের সাতদিন মেয়াদি একটি প্যাকেজে ৪০ জিবি ডাটার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪৯ টাকা। গিগাবাইটপ্রতি যার মূল্য পড়ে ৬ টাকা ২৩ পয়সা। অন্যদিকে সাতদিন মেয়াদি ২ জিবি প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮ টাকা। গিগাবাইটপ্রতি যার মূল্য পড়ে ৪৯ টাকা। এর বাইরে গিগাবাইটপ্রতি ১১ টাকা ২ পয়সা, ১৮ টাকা, ১৯ টাকা, ২৮ টাকা, ৩৪ টাকা ও ৪৬ টাকা মূল্যের প্যাকেজ রয়েছে।
অপারেটরটির ভয়েস কলের মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গ্রামীণফোনে সর্বনিম্ন ৫৪ পয়সা খরচ করে ১ মিনিট কথা বলা যায়। আবার প্যাকেজভেদে ১ টাকা ৯৪ পয়সাও ব্যয় হয়। অপারেটরটির ৯০ দিন মেয়াদি ৫০৯ টাকা ও ৯৮৯ টাকার প্যাকেজে এ দাম পড়ে। ১ থেকে ৫ দিন মেয়াদি প্যাকেজগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত ৮০ পয়সা থেকে শুরু করে ৯৯ পয়সা পর্যন্ত কল রেট আদায় করা হয় গ্রাহকদের কাছ থেকে। সাতদিনের বেশি মেয়াদি কল রেটগুলোর ক্ষেত্রে মিনিটপ্রতি মূল্য আরো কমে আসে।
সেলফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেডের মোবাইল ইন্টারনেট প্যাকেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাদের একদিন মেয়াদি চারটি প্যাকেজ, তিনদিন মেয়াদি তিনটি, সাতদিন মেয়াদি ছয়টি এবং ৩০ দিন মেয়াদি সাতটি প্যাকেজ রয়েছে। এসব প্যাকেজের মধ্যে সাতদিন মেয়াদি ১০০ গিগাবাইটের প্যাকেজের দাম ২৭৮ টাকা। গিগাপ্রতি দাম পড়ে ২ টাকা ৭৮ পয়সা। ৭ দিনের আরেক প্যাকেজে ৮ জিবির দাম ১৬৮ টাকা। গিগাপ্রতি মূল্য দাঁড়ায় ২১ টাকা। পাশাপাশি ৩০ দিন মেয়াদি ৩ জিবির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪৮ টাকা। গিগাপ্রতি মূল্য দাঁড়ায় ৪৯ দশমিক ৩৩ টাকা।
ভয়েস কলের ক্ষেত্রে প্যাকেজভেদে রবি মিনিটপ্রতি ৬৩ পয়সা থেকে ৯৫ পয়সা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। এর বাইরে ৩০ দিন মেয়াদি একটি প্যাকেজ ৭৯৬ টাকায় কিনতে হয়। ৫০০ মিনিটের এ প্যাকেজের মিনিটপ্রতি গড় দাম পড়ে ১ দশমিক ৫৯ টাকা।
এসব প্যাকেজ ছাড়াও বান্ডেল প্যাকেজ ও সীমিত সময়সীমার প্যাকেজও রয়েছে অপারেটরটির।
গ্রাহকরা বলছেন, অপারেটরদের ভিন্ন ভিন্ন প্যাকেজের কারণে সাধারণ গ্রাহকরা বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। বিভ্রান্তির কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখেও পড়ছেন তারা। আবার অপারেটররা ‘সাশ্রয়ী মূল্যে’ অনেক বেশি ডাটা দিলেও মেয়াদ থাকে খুবই কম। ফলে ডাটা শেষ করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের অফার বন্ধ করতে হবে।
নিজাম উদ্দিন নামে রবির এক গ্রাহক বলেন, ‘আমার ফোনে ১২ টাকার মতো ছিল। আমি একজনকে কল দিয়ে ৪ মিনিট কথা বলেছি। এ ৪ মিনিটের জন্য ১১ টাকার বেশি কেটে নেয়া হয়। মোবাইল অপারেটররা দেশের প্রত্যেকের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। তাদের এভাবে ব্যবসা করাটা অনৈতিক। ব্যবসা অবশ্যই করবে, তাই বলে যিনি কিছু জানেন না, তার কাছ থেকে ইচ্ছেমতো অর্থ আদায় করবে, সে সুযোগ থাকাটা উচিত নয়।’
অপারেটররা বলছেন, দেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য তাদের বিশাল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ২৪ ঘণ্টা সচল রাখতে হয়। অপারেটরদের ক্রয়কৃত নির্দিষ্ট গতিভিত্তিক ব্যান্ডউইডথই ইন্টারনেট নয়। এ ব্যান্ডউইডথকে ফাইবার নেটওয়ার্ক, বেতার তরঙ্গ ও ওয়্যারলেস প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছানোই মূলত মোবাইল ইন্টারনেট। আইআইজি পর্যায়ে যে ব্যান্ডউইডথ কেনা হয়, সেটি সবসময়ই নির্দিষ্ট পরিমাণ ও মেয়াদভিত্তিক। টেলিযোগাযোগ খাতে আগাম ব্যান্ডউইডথ কিনে অগ্রিম প্রভিশন বা বন্দোবস্ত করতে হয়। এ জন্য ব্যান্ডউইডথ বিক্রি হোক বা না হোক, তার দায় সবসময় অপারেটরদের বহন করতে হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যান্ডউইডথের সর্বোচ্চ গ্রাহক চাহিদা মাথায় রেখে ব্যান্ডউইডথ ক্রয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। চাহিদার বিপরীতে অগ্রিম ক্রয় করা ব্যান্ডউইডথ অব্যবহৃত থেকে গেলেও নির্দিষ্ট সময়সীমা অর্থাৎ মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়ে গেলে সেটির আর মূল্য থাকে না। ব্যান্ডউইডথ ব্যবহার না হলেও এর মূল্য মেয়াদের ভিত্তিতেই অপারেটরদের পরিশোধ করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই সব দেশেই গ্রাহকের কাছে যেসব প্যাকেজভিত্তিক ইন্টারনেট ডেটা বিক্রি হয়, প্রতিটি প্যাকের একটি মেয়াদ নির্ধারণ করা থাকে।
জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশনস শারফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘গ্রাহক পর্যায়ে মোবাইল ভয়েস অথবা ডাটার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ ধরনের তুলনা একটি অনুমিত দৃষ্টিভঙ্গি, যা সঠিক নয়। প্যাকেজ ডিজাইনের ক্ষেত্রে গ্রামীণফোন মূল্য, ভলিউম ও মেয়াদসহ সব কিছুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা ও নীতিমালা অনুসরণ করে তৈরি করে থাকে, যেন গ্রাহকদের চাহিদার প্রতিফলন ঘটে। এছাড়া গ্রামীণফোন ভয়েস অথবা ডাটার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন বৈশ্বিক পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ভোক্তাবাজারে যেকোনো পণ্য বা সেবার প্রতি ইউনিটের মূল্য পরিবর্তিত হতে পারে। এজন্য বড় প্যাকেজ নিলে গ্রাহকরা বেশি লাভবান হয়ে থাকেন। আপনারা লক্ষ করবেন, গ্রামীণফোন তাদের গ্রাহকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন সাশ্রয়ী ভয়েস ও ডাটা প্যাকেজ ডিজাইন করে থাকে।’
প্রতি মিনিট ২ টাকার ভয়েস চার্জ (ভ্যাট ও ট্যাক্স ব্যতীত) মূলত ট্যারিফ প্ল্যানের অন্তর্ভুক্ত। কোনো গ্রাহকের যদি সক্রিয় মিনিট বা কম্বো প্যাকেজ না থাকে সেক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হয়। এটি একটি বৈশ্বিক মানদণ্ড, যেখানে গ্রাহকরা প্যাকেজের মাধ্যমে কম খরচে সেবা পান। ডাটার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। বিশ্বের সব বাজারেই মোবাইল প্যাকেজগুলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তৈরি করা হয়, যেমন ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস, ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক মেয়াদে। এক্ষেত্রে গ্রাহকরা স্বাধীন এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ প্যাকেজ নির্বাচন করে থাকেন। এছাড়া গ্রাহকদের ক্রয়কৃত প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে মেয়াদের পরিবর্তন অথবা যেকোনো ধরনের অফার এসএমএসের মাধ্যমে অবহিত করা হয়।
জানতে চাইলে রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, ‘যেকোনো পণ্য বা সেবার ক্রয় বা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের দাম, পরিমাণ (ভলিউম), মান ও মেয়াদ ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। টেলিযোগাযোগ সেবার ক্ষেত্রে পৃথিবীর সব দেশের মতোই সেবার মূল্য নির্ভর করে সর্বমোট মিনিট, ইন্টারনেট ডেটার মোট পরিমাণ, এসএমএসের সংখ্যা ইত্যাদি এবং সর্বোপরি এর মেয়াদের ওপর। যদি ক্রয়ের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে খরচ কমে আসে। একইভাবে জিবি বা মিনিটের ক্ষেত্রেও যদি বেশি পরিমাণে ক্রয় হয়, তাহলে দাম কমে আসে।’
তিনি বলেন, ‘গ্রাহকরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্যাকেজ বেছে নিতে পারেন। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিভিন্ন প্রমোশনাল অফার ও ক্যাম্পেইন এ দামের পার্থক্য তৈরি করে। বিভিন্ন গ্রাহকের ব্যবহারের চাহিদা ভিন্ন এবং তার জন্য বিভিন্ন মেয়াদের বিভিন্ন ভলিউমের প্যাকেজ অ্যাভেইলেবল আছে। গ্রাহকদের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে যেকোনো প্যাকেজ পছন্দ করার এবং সেটা ক্রয় করার। এখানে লোকসানের প্রশ্নটি অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর।’
সাহেদ আলম বলেন, ‘মোবাইল সেবার মূল্য নির্ধারণে মেয়াদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অপারেটরদের যখন ব্যান্ডউইডথে আগাম বিনিয়োগ করতে হয়, সেটিতেও ভলিউম ও মেয়াদ থাকে। ওয়্যারলেস টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে স্পিড নির্ধারিত হয় টাওয়ারের অবস্থান ও ঘনত্বের ওপর। সুতরাং মেয়াদের মধ্যে ব্যবহার করা ছাড়া বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের জন্য বৈচিত্র্যময় প্যাকেজ রয়েছে।’
জানতে চাইলে মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এখানে বড় যে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ ধরনের প্যাকেজের ক্ষেত্রে কমিশনের অনুমতি নিতে হয় এবং কমিশন সেই অনুমতি দেয়। সাধারণ গ্রাহকরা এসবের কিছুই বোঝেন না। তারা শুধু ঠকে যায়। কমিশন কীভাবে এ ধরনের প্যাকেজের অনুমতি দেয়, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কমিশন কীভাবে এ ধরনের প্যাকেজের অনুমতি দেয়, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা উচিত।’
তিনি আরো বলেন, ‘গ্রাহকরা বড় প্যাকেজ কিনলেও অপারেটররা ইন্টারনেট ডাউন করার মাধ্যমে অনেক সময় পুরো ডাটা খরচ করতে দেয় না। লিমিটলেস প্যাকেজের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়।’
আপনার মতামত জানানঃ