নারীর প্রতি ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করার অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার মুখে পড়েছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদী শব্দ ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। প্রতিমন্ত্রীর এসব মন্তব্যকে ‘কুরুচিপূর্ণ’, ‘অশালীন’ ও ‘মর্যাদাহানিকর’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীরা।
তবে এসব সমালোচনা পাত্তা দিচ্ছেন না প্রতিমন্ত্রী মুরাদ। আলোচিত ভিডিওটি নিজের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সরিয়ে নিলেও মুরাদ হাসান বলছেন, তিনি আগের অবস্থানেই আছেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, তথ্যপ্রতিমন্ত্রীর মন্তব্য যাবতীয় ভব্যতা ও শিষ্টাচারকে অতিক্রম করেছে। তার বক্তব্য সরাসরি নারীবিদ্বেষী ও বর্ণবাদী। কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে কোনো মন্ত্রীর মুখ দিয়ে এমন বক্তব্য বের হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো। তিনি সরাসরি দুজন নারীকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেছেন। শুধু দুই নারীই নয়, তিনি আফ্রিকার মানুষদের সম্পর্কেও বর্ণবাদী মন্তব্য করেছেন।
যে কারণে বিতর্কিত তথ্য প্রতিমন্ত্রী
‘অসুস্থ খালেদা, বিকৃত বিএনপির নেতাকর্মী’ শিরোনামে এক ফেসবুক লাইভে যুক্ত হন মুরাদ হাসান। লাইভটির সঞ্চালক ছিলেন নাহিদ রেইনস নামে এক ইউটিউবার ও ফেসবুকার।
লাইভে বিএনপির রাজনীতি সমালোচনার এক পর্যায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ও দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে তিনি বিভিন্ন মন্তব্য করেন। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্ম ও পরিবার নিয়েও কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।
প্রতিমন্ত্রীর এসব বক্তব্য ‘প্রচণ্ড আপত্তিকর’ উল্লেখ করে তীব্র সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আলোচিত লাইভটি শনিবার রাত পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রীর ভেরিফায়েড পেজের টাইমলাইনে দেখা গেলেও সোমবার আর দেখা যাচ্ছে না। তবে টাইমলাইন থেকে সরিয়ে নিলেও প্রতিমন্ত্রীর ফেসবুক পেজের ভিডিও অংশে এটি দেখা গেছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে পলাতক তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমানকে নিয়ে মন্তব্য করে অনলাইন-অফলাইনে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান।
নারী অধিকারকর্মী থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদ, এমনকি সরকার দলীয় অনেক নেতাকর্মীও বলছেন— এমন ‘অশালীন’ মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত প্রতিমন্ত্রীর। তবে প্রতিমন্ত্রী নিজে বলছেন, এই ইস্যুতে ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) এক লাইভ অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী কথা বলেন চলমান বিভিন্ন ইস্যুতে। ওই সময়ই জাইমা রহমানকে নিয়েও মন্তব্য করেন তিনি। মুহূর্তেই তার বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে।
মুরাদ হাসানের অশ্লীল কথার বানে বিদ্ধ হয়েছেন খালেদা জিয়ার নাতনি জাইমা রহমান। পিতা তারেক রহমানের সঙ্গে তিনি বিদেশেই আছেন। তার সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। খুব বেশি প্রকাশ্যে আসেন না। লন্ডনে আইন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করে চাকরি করছেন। রাজনীতির সঙ্গে তার এখনো কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার অংশগ্রহণও নেই। তবে রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে ভবিষ্যতে তিনি রাজনীতিতে আসতে পারেন। কিন্তু এখনো তার রাজনীতিতে অভিষেক ঘটেনি। এর আগেই তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হলেন।
প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে অভব্য, শিষ্টাচার বহির্ভূত, নারীবিদ্বেষী, কুরুচিপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন অনেকেই। সরকারের দায়িত্বশীল একটি পদে থেকে এমন বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়— এমনটি বলেছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও। সে কারণেই বক্তব্য প্রত্যাহার করে প্রতিমন্ত্রী যেন ক্ষমা চান— এমন দাবি উঠেছে।
নিজের সমর্থনে যা বললেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী
বিষয়টি নিয়ে প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান বলেন, ‘যেহেতু আমি রাজনীতি করি, তাই আমি রাজনৈতিক কর্মী। সবকিছু সবাই ভালোভাবে নেবে, এ রকম তো কথা নেই। সমালোচনা করতেই পারে।’
সমালোচকদের অবশ্য বিরোধীপক্ষের সারিতে ফেলছেন মুরাদ হাসান। তিনি বলেন, ‘যারা সমালোচনা করেন, তারা আমাদের শত্রুপক্ষ বা বিরোধীপক্ষ বা বিরোধী দল বা ’৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। এরা তো সমালোচনা করবেই। এগুলো দেখার সময় আসলে আমার নেই।’
নারীর প্রতি অবমাননাকর শব্দ ব্যবহারের অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘নারীর প্রতি অবমাননা বুঝলাম না! কোন নারীর প্রতি?’
নিজের কথায় কোনো নারীর প্রতি অবমাননা হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। আমার মা আছে। আমি একজন মায়ের পেট থেকে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার বোন আছে, স্ত্রী আছে, আমার সন্তান আছে, কন্যা আছে। আমি কাউকে অবমাননা করে কোনো কথা বলার মানসিকতা পোষণ করি না। এটা সমালোচকদের, নিন্দুকদের… ওই যে বলে ‘‘পাছে লোকে কিছু বলে” ওই রকম হইছে আরকি। এসব নিয়ে মাথা ব্যথা দেখানোর মতো সময় আমার নেই।’
‘মক্ষীরানি’র মতো শব্দ ব্যবহারের যৌক্তিকতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান সাহেব কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন, বেগম জিয়া কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা কেউ কিন্তু বাংলার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেননি। তাদের পরিবারের ইতিহাস আসলে খুব পজিটিভ না। এগুলো পজিটিভ কোনো বিষয় না।
তিনি বলেন, ‘এগুলো সবাই আমরা জানি। বাংলাদেশে কেউ জন্ম নেয়নি এরা। বাংলাদেশকে কেউ ধারণ করেন না। বাংলাদেশকে লালন করেন না। বাংলাদেশকে বহন করেন না। বাংলার মানুষকেও তারা ভালোবাসেন না। যার ফলে তারা হত্যার রাজনীতি করেছেন। জিয়াউর রহমান হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিককে হত্যা করেছেন। এসব তো আপনারা জানেন সবই। খালেদা জিয়াও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাই করেছেন।’
তীব্র সমালোচনার মুখে তথ্য প্রতিমন্ত্রী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, ‘বক্তব্য প্রদানের সময় শব্দ চয়নে সবারই সচেতন থাকা উচিত। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই অবমাননাকর মন্তব্য করা ঠিক নয়।’
তথ্য প্রতিমন্ত্রীর আরও দায়িত্ব নিয়ে কথা বলা উচিত বলে মনে করেন দেশের প্রথম নারী হিসেবে প্রধান তথ্য কমিশনারের দায়িত্ব পালন করা অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম বলেন, ‘তথ্য প্রতিমন্ত্রী ফেসবুক লাইভে অংশগ্রহণ করে যে ধরনের মন্তব্য করেছেন, সেটি বাংলাদেশের একজন সুস্থ নাগরিক হিসেবে আমার কাছে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ মনে হয়েছে।
‘নারীকে হেয় করে কথা বলা ঠিক না। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫০ শতাংশই নারী, তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন। কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা কখনই কাম্য নয়।’
প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্যে তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, ‘আমি মনে করি এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি তার নিজের চিন্তা, অবস্থান, নৈতিকতা ও স্ট্যাটাস সবার কাছে পরিষ্কার করেছেন। প্রতিমন্ত্রী তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গোটা নারী জাতিকে অপমান আর অবমাননা করেছেন।’
খুশী কবির বলেন, ‘উনি (মুরাদ হাসান) সবচেয়ে বেশি অপমান করেছেন ওনার নেত্রী, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সব জায়গায় নারীর অধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য রাখছেন।’
খুশী কবির বলেন, “তিনি (মুরাদ হাসান) নিজে যখন বলেন যে ‘আমার মুখ ভীষণ খারাপ’, তখন তিনি একজন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিপরিষদে থাকেন কীভাবে সেটিই আমার বড় প্রশ্ন।”
প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বক্তব্যে ভীষণ ক্ষুব্ধ আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক। তিনি বলেন, ‘উনি (প্রতিমন্ত্রী) একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন, জাইমা কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে থাকেন, এটার মানে কী? কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে থাকাটা কী অপরাধ? কৃষ্ণাঙ্গ বলতে উনি কী বুঝিয়েছেন? কৃষ্ণাঙ্গরা খুবই খারাপ? কৃষ্ণাঙ্গরা খুবই সেক্সিস্ট? ওদের সঙ্গে খারাপ মেয়েরা থাকে?
‘আমরা কিন্তু এখন কৃষ্ণাঙ্গ শব্দটাই ব্যবহার করি না। আমরা বলি আফ্রিকান-আমেরিকান। আমরা নিগ্রো বলি না। আমরা ব্ল্যাক বলার সময় চিন্তা করি, বলব কি না। কিন্তু উনি অবলীলায় বলে ফেললেন। এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক, হতাশাজনক।
জিনাত আরা হক হতাশা জানিয়ে বলেন, ‘পার্লামেন্টে লেখাপড়া জানা মানুষ গেলে আমরা খুবই খুশি হই। কিন্তু এই যদি হয় লেখাপড়ার হাল, তাহলে আমাদের চিন্তা করতে হবে যে, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া দিয়ে আমরা আসলে কী শিখছি।’
তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে- ব্যক্তি, বিশেষ করে নারীদের উনি প্রচণ্ডভাবে হেয় করেছেন। তার কথাগুলো শুনতেই আমার কষ্ট হচ্ছিল।’
জিনাত আরা হক বলেন, ‘উনি (প্রতিমন্ত্রী) ‘মক্ষীরানির’ মতো শব্দ বলেছেন। এ ধরনের কথা বলার মধ্য দিয়ে যে নারীরা প্রান্তিক, যে নারীরা অনেক বেশি বিপর্যস্ত, তাদের আরও বিপর্যস্ত করছেন। এই শব্দগুলো আসলে কারা বলে? যারা লেম্যান, যাদের জানাশোনা কম, সমাজে যারা প্রথাগত আচরণ করে তারা বলে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ