দুর্নীতির মামলায় সাময়িক বরখাস্ত কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজনস) পার্থ গোপাল বণিককে খাস কামরায় অতি গোপনে জামিন দেওয়ায় বিচারকের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারকের এই কর্মকাণ্ডকে অপ্রত্যাশিত-লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। জামিন প্রদানকারী বিচারক সম্পর্কে আদালত বলেছেন, জেলা জজ পর্যায়ের একজন বিচারকের এ ধরনের আচরণ ও কাজ অপ্রত্যাশিত-লজ্জাজনক। তাকে জামিন দেওয়া আদালত অবমাননার সামিল।
বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ১২ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করেছেন। ওই রায়ে আদালত এসব মন্তব্য করেন।
হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চের বিচারকেরা বলেন, ‘আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে জেলা জজ পর্যায়ের একজন বিচারকের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ ও কর্ম প্রত্যাশিত নয়। তার এ ধরনের আদেশ উচ্চ আদালতের প্রতি অবজ্ঞা এবং যা আদালত অবমাননার শামিল। হাইকোর্ট বিভাগ ইতিপূর্বে আসামির জামিন নাকচ করে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিজ্ঞ বিচারক আসামিকে জামিন প্রদান করে হাইকোর্টের আদেশকে অবজ্ঞা করেছেন।’
এর আগে গত ১৭ জুন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ইকবাল হোসেনের ভার্চুয়াল আদালত পার্থ গোপাল বণিককে ১৫ জুলাই পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন। এরপর তিনি কারামুক্ত হন।
পরে ওই জামিনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন জানায় দুদক। সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পার্থ গোপাল বণিককে ‘অস্বাভাবিক পন্থায়’ জামিন দেওয়ার ঘটনায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত–৫ এর বিচারক ইকবাল হোসেন হাইকোর্টে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এরপর গত ২ সেপ্টেম্বর পার্থ গোপাল বণিককে নিম্ন আদালতের দেওয়া জামিন বাতিল করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তাকে আগামী ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। এ ছাড়াও মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন আদালত।
গত ২৮ জুন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না করে পার্থ গোপাল বণিককে অস্বাভাবিকভাবে জামিন দেওয়ার ঘটনায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত–৫–এর বিচারক ইকবাল হোসেনের কাছে ব্যাখ্যা চান হাইকোর্ট। একইসঙ্গে পার্থ গোপাল বণিককে অস্বাভাবিকভাবে জামিন দেওয়ার বিষয়ে চ্যানেল ২৪ এ প্রচারিত প্রতিবেদনের ভিডিও ক্লিপ আদালতে দাখিল করতে বলা হয়। এছাড়া পার্থ গোপাল বণিকের জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন শুনানির জন্য গ্রহণ করেন আদালত।
হাইকোর্টের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে লিখিত ব্যাখ্যা দেন বিচারক ইকবাল হোসেন।
ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, ফৌজদারি আপিল নং (১০৫৩৪/১৯) মামলায় গতবছরের ২ নভেম্বর হাইকোর্ট এক আদেশে পার্থ গোপাল বণিকের মামলার বিচার ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্নের জন্য জজ ইকবাল হোসেনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ আদেশ যথাসময়ে না পৌঁছায় ছয় মাসের সময়সীমা অতিক্রম হয়েছে বলে আসামির আইনজীবী বিশেষ আদালতকে জানায়। এছাড়া ফৌজদারি রিভিশন মামলা নং (১৪৫/২১) মামলায় গত ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট অপর এক আদেশে মামলাটির বিচার এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে বলা হয়। গত ১০ মার্চ এ আদেশের অনুলিপি পান। এ আদেশে উল্লিখিত সময়সীমার মেয়াদ এখনও রয়েছে। বিশেষ আদালতের বিচারক ইকবাল হোসেন ব্যাখ্যায় বলেছেন, তিনি হাইকোর্টের আদেশ প্রতিপালনে সদা সচেষ্ট রয়েছেন।
পার্থ গোপাল বণিককে অস্বাভাবিকভাবে জামিন দেওয়ার বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী মনিরুজ্জামান লিংকন। এছাড়া তার জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করে দুদক।
২০১৯ সালের ২৭ জুলাই ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তখন তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৮০ লাখ টাকা অর্জন করেন।
গত ১৯ জুন জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় পার্থ গোপাল বণিক জামিন পান। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত–৫–এর বিচারক ইকবাল হোসেন ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় তাকে জামিন দেন। পরদিনই তিনি জেল থেকে বের হন। অনেকটা গোপনে ও তড়িঘড়ি করে এ জামিন দেওয়া হয় ও তিনি কারামুক্ত হন।
এ মামলায় গতবছরের ৪ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
২০১৯ সালের ২৭ জুলাই ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তখন তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৮০ লাখ টাকা অর্জন করেন। সেই টাকা নিজ বাসার ক্যাবিনেটে লুকিয়ে রাখেন।
২৮ জুলাই সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দুদকের সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের পরিচালক মুহাম্মদ ইউছুফের নেতৃত্বে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় পার্থ গোপাল বণিককে। ঘুষ ও দুর্নীতির কয়েক লাখ নগদ টাকা তার বাসায় রয়েছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে সেদিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পার্থ গোপাল বণিকের বাসায় অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ৮০ লাখ টাকা জব্দ করা হয় এবং তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা হয়।
পরে দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ দুদকের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধান দলের নেতা মো. সালাউদ্দিন বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
এরপর ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে পার্থ গোপাল বণিককে গ্রেপ্তারের দিন থেকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামি পার্থ গোপাল বণিক গতবছরের ২৮ জুলাই দুদকে হাজির হয়ে অনুসন্ধান টিমের কাছে বক্তব্য দেন। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে পার্থ গোপাল বণিক জানান, তার বাসায় ৩০ লাখ টাকা নগদ আছে। এ টাকার বৈধ উৎস তিনি দেখাতে পারেননি। পরে অভিযান চালিয়ে তার বাসা থেকে ৮০ লাখ টাকা জব্দ করা হয়। এ মামলায় হাইকোর্টে একাধিকার জামিন আবেদন করেও তিনি জামিন পাননি।
পার্থ গোপাল বণিক ১৯৯৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। আর ২০০২ সালে তিনি জেল সুপার পদে চাকরিতে যোগ দেন। ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর তিনি কারা উপমহাপরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৫
আপনার মতামত জানানঃ