মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি অভিবাসন আটককেন্দ্রে বন্দিরা চিকিৎসাসেবার অস্বীকৃতি এবং অপমানজনক পরিস্থিতির কথা জানিয়েছে, যা দু’টি মৃত্যুর সাথেও সম্পর্কিত হতে পারে বলে মানবাধিকার সংস্থার এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
সোমবার প্রকাশিত এই তদন্ত প্রতিবেদনে ফ্লোরিডার মায়ামি ও আশপাশের তিনটি কেন্দ্রে—ক্রোম নর্থ সার্ভিস প্রসেসিং সেন্টার, ব্রোয়ার্ড ট্রানজিশনাল সেন্টার এবং ফেডারেল ডিটেনশন সেন্টারে—বন্দিদের অবস্থা তুলে ধরা হয়। সেখানে নারী বন্দিদের পুরুষদের কেন্দ্রে রাখা, চরম অতিরিক্ত ভিড় এবং চিকিৎসার প্রতি অবহেলার মতো বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনের লেখকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যাপক বহিষ্কারের অভিযানের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে যে অবকাঠামোগত চাপ তৈরি হয়েছে, এই নির্যাতন তারই প্রতিফলন। এর জের ধরেই ফ্লোরিডায় রাজ্য সরকারের অর্থায়নে তৈরি নতুন কেন্দ্র ‘অ্যালিগেটর আলকাট্রাজ’-সহ অনেক বিতর্কিত কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, আমেরিকানস ফর ইমিগ্রান্ট জাস্টিস এবং স্যাংচুয়ারি অব দ্য সাউথের যৌথভাবে প্রস্তুত করা ৯২ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনের সাথে প্রকাশিত বিবৃতিতে সংস্থার ক্রাইসিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট পরিচালক বেলকিস উইলে বলেন, “অভিবাসন আটককেন্দ্রে মানুষকে মানুষের মতো দেখা হচ্ছে না।”
“এসব আলাদা ঘটনা নয়, বরং পুরো সিস্টেমটাই ভাঙা, যেখানে নির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা,” বলেন তিনি।
প্রতিবেদনটি বর্তমান ও সাবেক বন্দিদের সাক্ষ্য, তাদের পরিবারের সদস্য, আইনজীবী এবং ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (ICE)-এর তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি। এখানে দেখা গেছে, অনেক সময় চিকিৎসা সেবা পুরোপুরি অস্বীকৃত হয়েছে বা বিলম্বিত হয়েছে।
একজন বন্দি জানান, এপ্রিলের শেষদিকে ৪৪ বছর বয়সী হাইতির নাগরিক মেরি আঞ্জ ব্লেইজ গুরুতর শারীরিক সমস্যায় ভুগলেও ব্রোয়ার্ড ট্রানজিশনাল সেন্টারের রক্ষীরা তাদের চিৎকার উপেক্ষা করে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর উদ্ধারকর্মীরা আসলেও তখন ব্লেইজ আর নড়ছিলেন না।
এ বন্দি আরও বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চাইলে তাকেও শাস্তি পেতে হয়েছে। অনেককে এই কারণেই একাকী বন্দিত্বে (solitary confinement) রাখা হয়েছে।
আরেক ঘটনায়, ৪৪ বছর বয়সী ইউক্রেনের নাগরিক ম্যাকসিম চেরনিয়াক ক্ৰম ডিটেনশন সেন্টারে জ্বর, বুকে ব্যথা এবং অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসার অনুরোধ করলেও বারবার অবহেলা করা হয়। পরে যখন চিকিৎসকের দেখা পান, তখন উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে—কিন্তু যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।
পরবর্তী সময়ে যখন তিনি বমি করতে থাকেন, মুখ থেকে লালা ঝরতে থাকে এবং নিজেই মলত্যাগ করেন, তখন সহবন্দি কার্লোস জানান, কর্তৃপক্ষ ১৫–২০ মিনিট পর সাড়া দেয় এবং অভিযোগ করে যে চেরনিয়াক অবৈধ মাদক নিয়েছেন। কিন্তু কার্লোস তা অস্বীকার করেন।
পরে তাকে স্ট্রেচারে করে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর মস্তিষ্কে মৃত্যু ঘটে এবং দুই দিন পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
তিনটি কেন্দ্রে বন্দিদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অনেকে জানান, ৬ জনের জায়গায় ৩০–৪০ জনকে রাখা হচ্ছে। বালিশ, সাবান ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ ফ্লোরে ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছেন।
ক্রোম কেন্দ্রে শুধুমাত্র পুরুষদের রাখার কথা থাকলেও সেখানে নারীদেরও প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। সেখানে বন্দি নারীরা জানান, গোসল করতে দেওয়া হয়নি এবং খোলা শৌচাগার ব্যবহার করতে হয়েছে, যেখান থেকে পুরুষ বন্দিরা সহজেই দেখতে পারতেন।
আর্জেন্টিনার এক নারী জানান, “পুরুষরা যদি চেয়ারে উঠে দাঁড়ায়, তাহলে তারা আমাদের ঘর আর টয়লেট পরিষ্কার দেখতে পারবে। আমরা গোসলের জন্য অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু তারা বলেছে, এটা সম্ভব না কারণ এটা পুরুষদের কেন্দ্র।”
অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়া, দীর্ঘ সময় শৃঙ্খলবদ্ধ রাখা এবং চরম গরম ও ঠাণ্ডার মধ্যে ফেলে রাখার মতো আরও অনেক অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
ব্রিটিশ ব্যবসায়ী হারপিন্ডার চৌহান, যিনি ফেব্রুয়ারিতে নিয়মিত ইমিগ্রেশন সাক্ষাতে গিয়ে আটক হন এবং একাধিক কেন্দ্রে ঘুরতে থাকেন, জানান, একবার টয়লেটের দাবি করলে কেন্দ্রের কর্মীরা বলেন, “আপনারা যদি ফ্লাশ করা টয়লেট চান, তাহলে এমন সমস্যা তৈরি করব, যেটা আপনারা মোটেও পছন্দ করবেন না।”
প্রতিবেদনের লেখকরা বলেন, এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক আইন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিমালার লঙ্ঘন। ট্রাম্প প্রশাসন প্রমাণ ছাড়া অভিবাসীদের অপরাধী বানিয়ে গণবহিষ্কারের পরিকল্পনা করে, কিন্তু এর জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি।
২০ জানুয়ারি ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বন্দি সংখ্যা ছিল ৩৯,২৩৮। ১৩ জুলাই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬,৮১৬—যা ট্রান্স্যাকশনাল রেকর্ডস অ্যাক্সেস ক্লিয়ারিংহাউসের তথ্য থেকে জানা গেছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন বছরের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর ধারণক্ষমতা ৪০,০০০ থেকে ১,০০,০০০-এ নিতে চায়। এর জন্য সামরিক ঘাঁটি ও ICE-এর জমিতে দ্রুত নির্মাণযোগ্য তাঁবুর মতো কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে।
ট্রাম্প সম্প্রতি একটি ট্যাক্স এবং ব্যয় বিল স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে নতুন আটককেন্দ্র তৈরিতে ৪৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে—যা নজিরবিহীন।
সম্প্রতি মার্কিন স্বরাষ্ট্র সচিব ক্রিস্টি নোম বলেছেন, ফ্লোরিডার মতো অঙ্গরাজ্যের সাথে আরও সহযোগিতা বাড়িয়ে রাজ্য অর্থায়নে নতুন কেন্দ্র তৈরি করা হবে, যেমন “অ্যালিগেটর আলকাট্রাজ”—যেটি ফেডারেল নয়, বরং রাজ্য করদাতাদের অর্থে প্রথমে গড়ে তোলা হচ্ছে। অনুবাদ: শুভ্র সরকার।
আপনার মতামত জানানঃ