যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বব্যাপী যে বৈদেশিক সহায়তা কার্যক্রমে ব্যাপক কাটছাঁট আরোপ করেছে, তা শুধু কূটনৈতিক ভারসাম্য নয়—মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট-এ প্রকাশিত নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, এই তহবিল সংকোচনের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে, যাঁদের এক-তৃতীয়াংশই শিশু।
এই সংখ্যা কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়; এটি মানবতার জন্য এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা। গবেষণাটি করেছে বার্সেলোনা ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল হেলথের (আইএসগ্লোবাল) গবেষক দল, যেখানে ১৩৩টি দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ চালানো হয়েছে। তারা দেখিয়েছে, ইউএসএআইডির কার্যকরী তহবিলের মাধ্যমে ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯ কোটি ১০ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে ইউএসএআইডির ৮৩ শতাংশ বাজেট কাটার পরিকল্পনা কার্যকর হলে সেই প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে, এবং এর ফলে মানব সভ্যতা হয়তো এক নতুন অন্ধকার যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
তহবিল সংকোচনের সর্বাধিক প্রভাব পড়বে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। এই দেশগুলো এমনিতেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রতিদিন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। ইউএসএআইডির মতো বৈদেশিক সহায়তা সংস্থার অর্থায়ন এসব দেশের জন্য অক্সিজেনের মতো। আর সেই অক্সিজেন সরবরাহ যদি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে জীবনের চাকা থেমে যাবে।
গবেষক ডেভিড রাসেলা এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এ সিদ্ধান্ত দুই দশকের স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতিকে সম্পূর্ণ উল্টে দিতে পারে। তাঁর ভাষায়, “এটা এক বিশ্বব্যাপী মহামারির মতোই বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াতে পারে।” যদি এই আর্থিক সংকোচন বাস্তবায়িত হয়, তাহলে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে—যা শিশুদের জন্য এক নিরব গণহত্যার শামিল।
এই সম্ভাব্য প্রাণহানির সংখ্যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত সেনাসদস্যদের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইতিহাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ১ কোটি সেনা। এখন একটি বাজেটীয় সিদ্ধান্ত তার চেয়েও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, তহবিল কাটছাঁটের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে মা ও শিশুস্বাস্থ্যের ওপর। অসংখ্য শিশু অপুষ্টি, সংক্রামক রোগ এবং চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে পারে। মায়েরা নিরাপদ প্রসবের সুযোগ হারাতে পারেন। এই বিপর্যয় শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না—এর প্রভাব পড়বে শিক্ষায়, খাদ্য নিরাপত্তায় এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখায়।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এই তহবিল সংকোচনকে নেতৃত্বের গর্ব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার কিছুদিন পর তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ও বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক গর্ব করে বলেছিলেন, ইউএসএআইডির কার্যক্রম সংকুচিত করা হবে। এই ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে শঙ্কার সৃষ্টি হয়, যার বাস্তব প্রতিফলন আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।
গবেষণা প্রতিবেদনটি এমন এক সময়ে প্রকাশ পেল, যখন স্পেনে জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা জড়ো হচ্ছেন বৈশ্বিক সহায়তা কার্যক্রমে গতি ফেরানোর প্রত্যাশায়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, কারণ এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—বিশ্ব মানবতা কোন পথে হাঁটবে? জীবন বাঁচানোর পথে, নাকি অর্থনীতির নামে জীবন ধ্বংসের পথে?
এই ফিচার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত শুধু একটি দেশের সীমানার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না। এর অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের প্রতিটি কোণে। উন্নয়নশীল বিশ্বের শিশুদের কাঁধে যেন ধনী বিশ্বের বাজেটীয় ভার চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি শুধু অমানবিক নয়, এটি এক নির্লজ্জ নিষ্ঠুরতা।
বিশ্বনেতাদের এখন জরুরি ভিত্তিতে তহবিল পুনর্বহাল করার পদক্ষেপ নিতে হবে। কূটনৈতিক আলোচনার বাইরে এসে জীবন রক্ষাই হতে হবে এখন সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। তা না হলে, ইতিহাস হয়তো এই সংকোচনকে স্মরণ করবে এক নীরব গণহত্যা হিসেবে—যার দায় থেকে কেউ রেহাই পাবে না।
আপনার মতামত জানানঃ