যেকোন অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় বাংলাদেশে প্রশাসনের জালে সবসময় চুনোপুঁটিরা ধরা পড়ে, রাঘববোয়ালরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই এবার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাঘববোয়ালদের নয়, শুধু চুনোপুঁটিদের ধরতে ব্যস্ত বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। রবিবার (২৭ নভেম্বর) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির মামলায় ব্যাংকটির সাবেক কর্মকর্তা এ এস এম হাসানুল কবিরের জামিন বাতিল চেয়ে আবেদনের শুনানিকালে এমন মন্তব্য করেন আদালত। এসময় দুদকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এম এ আজিজ খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক।
মামলাটির শুনানিকালে দুদকের আইনজীবীকে হাইকোর্ট বলেন, ‘ঋণখেলাপিরা আইনের চেয়ে শক্তিশালী নয়। তাহলে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? হাজার হাজার কোটি টাকা লোন নিয়ে খেলাপি হচ্ছে, আপনারা ধরছেন না কেন? যারা বড় বড় ঋণখেলাপি তারা কি বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবে? যারা অর্থশালী তারা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে? দুদক রাঘববোয়ালদের নয়, শুধু চুনোপুঁটিদের ধরতে ব্যস্ত।’’
বিসমিল্লাহ টাওয়েলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরীসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে ২৯ মার্চ রমনা থানায় মামলাটি করেন শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ইস্কাটন শাখার ব্যবস্থাপক নকীবুল ইসলাম।
মামলায় ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর ব্যাংকটির ইস্কাটন শাখার সাবেক ডেপুটি ম্যানেজার এ এস এম হাসানুল কবীর, তৎকালীন জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মান্নাতুল মাওলাসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
মামলায় ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর ওই দুজন বিচারিক আদালত থেকে জামিন পান। এ জামিন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করে দুদক। শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুল দেন। আর ২০১৮ সালে ওই মামলায় অধিক তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারিক আদালত। দুজনের জামিন বাতিল প্রশ্নে রুল শুনানির জন্য আজ বিষয়টি আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।
আদালতে দুদকের পক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও এম এ আজিজ খান শুনানিতে ছিলেন। দুই আসামির পক্ষে আইনজীবী মো. জিয়াউল হক ও রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন শুনানিতে ছিলেন।
শুনানিতে দুদকের আইনজীবীদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘১১০ কোটি টাকা নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে ২০১৩ সালে এজাহার হলো। ২০১৫ সালে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এদের কেন ধরতে পারছেন না? এদের ধরবে কে? আপনারা ধরছেন চুনোপুঁটি। এতে কী বোঝা যায়; যারা অর্থশালী, ক্ষমতাবান, তাদের বিরুদ্ধে মামলা (বিচার) হবে না। এরা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে?’
এ সময় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘অবশ্যই দুদকের ধরা উচিত, এদের ধরবে।’
দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘২০১৮ সালের অধিক তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারিক আদালত। বছরের পর বছর চলে গেছে। অধিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়নি, এখনো অভিযোগপত্রও হয়নি। বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখবেন—এ নিয়ে দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলবেন। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত—৯ বছর চলে গেছে। এরা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে? কেন প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে না?’
একপর্যায়ে ওই দুই আসামির আইনজীবী মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘আমরা তো নিম্নস্তরের ব্যাংকার।’ আদালত বলেন, ‘মামলার প্রধান আসামি খাজা সোলায়মান কে?’ তখন খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘বিসমিল্লাহ গ্রুপের, উনি পলাতক। এক মামলায় তাঁর সাজাও হয়েছে। তাঁকে ধরতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করতে আদালতের আদেশ আছে।’
শুনানির একপর্যায়ে অন্য এক মামলার জন্য আদালতে আসেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘দেখেন, মামলার অবস্থা। ২০১৩ সালের মামলায় এখনো অভিযোগপত্র হয়নি, প্রতিবেদন দেয়নি।’ এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলকে কথা বলতে বলেন আদালত। একপর্যায়ে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘হালনাগাদ তথ্য জানাব।’ পরে আদালত ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৪৭
আপনার মতামত জানানঃ