বাংলাদেশে দুনীতি দমন কমিশন গঠিত হওয়ার পর প্রথম যেদিন নতুন কমিশন দায়িত্ব নিতে যায়, সেদিন তারা কার্যালয়ে কোনো চেয়ার-টেবিল পাননি।
দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর। সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয় দুর্নীতি দমন ব্যুরো। গঠিত হয় কমিশন।
কিন্তু কমিশন কার্যালয়ে দায়িত্ব নিতে গিয়ে বিব্রত হন নতুন চেয়ারম্যান এবং কমিশনাররা। তাদের জন্য কোনো চেয়ার-টেবিল না থাকায় অগত্যা চেয়ার-টেবিল ছাড়াই তাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছিলো। বিষয়টি সেসময় গণমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়।
চাইলে শুরুর এই বিব্রতকর পরিস্থিতিকে প্রতীকী হিসেবেও দেখা যায়। কারণ এরপরে গেলো দুই দশকে দুদকের যে যাত্রা, সেটি খুব একটা সহজ হয়নি।
দুদক দুর্নীতি দমনে স্বাধীন এবং কার্যকর ভূমিকা রাখবে এমন প্রত্যাশা করা হলেও বাস্তবে দুদক দুর্নীতিতে নজরদারি এবং সেটি দমনে ব্যর্থ হয়েছে বলেই অভিযোগ। এছাড়া এমন অভিযোগও রয়েছে যে, দুদক সরকারের পছন্দ অনুযায়ী দুর্নীতির মামলা দায়ের করে কিংবা দায়মুক্তি দেয়।
বিশেষ করে ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ, আমলা কিংবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সেগুলো খুব কমই আমলে নেয়া হয়।
কিন্তু আইনিভাবে স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী একটি প্রতিষ্ঠানের এমন অবস্থা কীভাবে হলো? দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের ভূমিকা নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠছে?
ব্যুরো থেকে কমিশন: কী লাভ হয়েছে?
বাংলাদেশে একসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করতো মূলত দুর্নীতি দমন ব্যুরো। কিন্তু সেটি ছিল প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অধীন। ফলে ব্যুরোর কার্যকলাপ ছিল অনেকটা বিরোধী দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
এমন অবস্থায় দেশটিতে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য দাতা দেশ এবং সংস্থাগুলোর তীব্র চাপ ছিল। সুশীল সমাজ থেকেও একইভাবে চাপ দেয়া হতে থাকে।
এরই একপর্যায়ে ২০০৪ সালে তৎকালীন সরকার এর উদ্যোগ নেয়। প্রথমে পাশ হয় দুর্নীতি দমন আইন। গঠিত হয় কমিশন নিয়োগের বাছাই কমিটি। সবশেষ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং কমিশনার নিয়োগের মাধ্যমে গঠিত হয় দুদক। সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয় দুর্নীতি দমন ব্যুরো।
সেসময় দাতাগোষ্ঠী এবং সুশীল সমাজ থেকে আশা করা হয়েছিলো এটি হবে নিরপেক্ষ, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এমনকি তখনকার বিএনপি সরকারও দুদক প্রতিষ্ঠাকে অর্জন হিসেবে উল্লেখ করে এর স্বাধীনতার কথাই বলেছিলো। কিন্তু বাস্তবে সে সময়তো বটেই পরবর্তীকালেও সেটা আর বাস্তব হয়নি।
“দুদকে যারা চেয়ারম্যান এবং কমিশনার হয়েছিলেন, শুরু থেকেই তাদের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে শেষ পর্যন্ত কমিশন ঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি।” বলছিলেন দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম।
সেসময় দুদক যথাযথভাবে কর্মী নিয়োগ এবং কার্যবিধিও তৈরি করতে পারেনি। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যক্রমেও একরকম অচলাবস্থা তৈরি হয়।
মঈদুল ইসলাম বলেন, “প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৭ এর ওয়ান-ইলেভেনের সরকার আসা পর্যন্ত দুদক তেমনভাবে কোনো মামলা-মোকদ্দমা বা অনুসন্ধান করতে পারেনি। সাবেক ব্যুরোর কর্মকর্তাদের থেকে যোগ্যদের বাছাই করে কমিশনে নেয়ার কথা থাকলেও সেটা হয়নি। শেষ পর্যন্ত তারা কিছু কর্মকর্তা নিয়েছেন, তবে সেটা পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে।”
“কমিশনের বিধি তৈরি এবং দুর্নীতির মামলা-মোকদ্দমার যে প্রক্রিয়া সেটা ওয়ান-ইলেভেনের সরকার আসার পর নতুন চেয়ারম্যানের অধীনে জোরদার দেখা গেলো। ২০০৯ সালের পর নতুন সরকার যখন আসলো, তখন তারা মামলা দেয়ার কাজগুলো জারি রাখলো। কিন্তু এসব পদক্ষেপে সরকারের লোকদের দিকে খুব একটা যায়নি দুর্নিতি দমন কমিশন।”
সবমিলিয়ে দুদককে দুর্নীতি দমন ব্যুরোরই একটা ‘উন্নত সংস্করণ’ হিসেবেই দেখছেন দুদকের সাবেক এই মহাপরিচালক।
একইভাবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানও বলছেন, দুদক শুরু থেকেই তার স্বাধীন ক্ষমতা, সেটা দেখাতে পারেনি।
দুর্নীতির যে ব্যাপকতা, সে অনুযায়ী দুদক কি সক্রিয়?
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতিতে শীর্ষ দেশগুলোর একটি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির সর্বশেষ বৈশ্বিক ধারণা সূচকে দেশটির অবস্থান দশম। এছাড়া দেশটির ভেতরে সেবাখাতে টিআইবি’র যে জরিপ সেখানেও দেখা যায় সেবাগ্রহণকারী খানার ৭০ শতাংশেরও বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পাসপোর্ট, বিআরটিএ থেকে শুরু করে দুর্নীতির ব্যাপকতা দেখা গেছে বিচারিক সেবা এমনকি স্বাস্থ্যখাতেও।
সামগ্রিকভাবে জরিপকালীন বছরে দুর্নীতির আর্থিক পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে বাস্তবে দুর্নীতির ব্যাপকতা আরও বেশি বলেই মনে করা হয়।
এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের ব্যবস্থা নেয়ার কথা। অভিযোগ পেলে কিংবা স্বপ্রণোদিত হয়েও দুদক ব্যবস্থা নিতে পারে। যে কোনো দুর্নীতির অনুসন্ধান, তদন্ত, মামলা এমনকি গ্রেফতারও করতে পারে।
কিন্তু দেখা যায়, পুলিশের সাবেক প্রধানসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যেসব দুর্নীতি এখন প্রকাশিত হচ্ছে, দুদক সেগুলো আগে থেকে ধরতে পারেনি। গণমাধ্যমে অভিযোগ আসার পরই দুদক তৎপর হচ্ছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যারা ক্ষমতার কাছাকাছি আছে দুদক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
“চুনোপুঁটির ক্ষেত্রে দুদক এখনও পর্যন্ত ভালো টানা-হেঁচড়া করতে পেরেছে বা পারছে। কিন্তু যাদেরকে আমরা রুই-কাতলা বলি তারা যদি সরকারের প্রতিপক্ষ হন কিংবা কোনো কারণে যদি সরকারের বিরাগভাজন হয়ে থাকেন, তাহলে অতিতৎপর হয়ে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে দুদক। আর যারা ক্ষমতার কাছাকাছি আছে বলে বিবেচিত হয়, তাদের ক্ষেত্রে দুদক কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পেরেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল।”
আইনি দুর্বলতা নাকি সাহসের অভাব?
কিন্তু আইনিভাবে স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী একটি প্রতিষ্ঠানের এমন অবস্থা কীভাবে হলো? প্রতিষ্ঠানটির কি কোনো আইনি দুর্বলতা আছে?
জানতে চাইলে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক অবশ্য আইনি দুর্বলতার কারণ নাকচ করে দিচ্ছেন।
“আমি সবসময় বলি যে, দুদকের আইনে যে শক্তি দেয়া আছে সেটা অ্যাটম বোমার মতো শক্তি। কারণ এখানে কাউকে ছাড় দেয়ার মতো সুযোগ নেই। একদিকে বিচার বিভাগ বলেন, অন্যদিকে পুলিশ-সেনাবাহিনী বলেন, কোনোদিকেই দুদকের যেতে মানা নেই। বরং অবাধ ক্ষমতা। যেখানেই দুর্নীতি ঘটবে, সেখানেই দুদক যেতে পারবে।”
তাহলে এখানে কীসের অভাব? এমন প্রশ্নে টিআআইবির নির্বাহী পরিচালক বলছেন, দুদক সেভাবে সাহসী নেতৃত্ব পায়নি।
তিনি বলেন, “এখানে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়োগ থেকে শুরু করে পদায়ন এবং প্রতিষ্ঠানটির যে ব্যবস্থাপনা সেটার মধ্যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রয়ে গেছে। যেমন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে একেবারেই জন্মলগ্ন থেকেই রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে। শুরুর সেই ট্রেন্ড পরেও থেকে গেছে।”
“আর সবচেয়ে বড় কথা এখানে যে ধরনের নেতৃত্ব দরকার সেটা দুদক কখনোই পায়নি। যেহেতু রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের নিয়োগ, সেকারণে রাজনৈতিক আনুগত্যের পাশাপাশি কোন ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া যাবে আর কোন ক্ষেত্রে নেয়া যাবে না, সেটা নির্ধারণে অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় দ্বারা প্রভাবিত হতে দেখা যায়।”
এছাড়া যারা দুদকে নেতৃত্ব দেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হলেও তারা স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের সাহস দেখান না।
“এই সাহসটা দেখা যায় না। কারণ আমাদের এখানে এমন উদাহারণও আছে যে, যদি পারিবেশের বাইরে গিয়ে বা পরিস্থিতির বাইরে গিয়ে সাহস দেখানো হয়, তাহলে তাকে মূল্য দিতে হতে পারে।” বলেন দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম।
কমিশনে রাজনৈতিক বিবেচনায় চেয়ারম্যান এবং কমিশনার নিয়োগ ছাড়াও আরেকটি বিষয়ে আপত্তি আছে বিশ্লেষকদের। সেটা হচ্ছে, দুদকে শীর্ষ পদগুলোতে সরকারি কর্মকর্তাদের ডেপুটেশনে নিয়োগ।
বলা হয়ে থাকে, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে প্রেষণে আসা এসব কর্মকর্তার আনুগত্য শেষ পর্যন্ত সরকারের দিকেই থাকে। কারণ তিন বছর পর তাদেরকে আবার সরকারের নির্ধারিত দপ্তরেই ফেরত যেতে হবে।
সব মিলিয়ে দুদকের ব্যবস্থাপনা একরকম আমলা নিয়ন্ত্রিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, গত বছর কমিশনের প্রশাসনিক নির্দেশের মাধ্যমে নির্বাহী কর্তৃত্ব সচিবের হাতে তুলে দেয়া। এটি করেছে খোদ দুদক নিজেই।
“কোন কর্মকর্তা তদন্তের দায়িত্ব পাবেন, কাকে বদলি করা হবে, পদোন্নতি দেয়া হবে -এ ধরনের বিষয়গুলো যেটা আগে কমিশন নিজেই নির্ধারিত করতো সেটা হস্তান্তর করা হয়েছে দুদক সচিবের হাতে,” বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
মন্তব্য নেই দুদকের
সামগ্রিকভাবে দুদকের এই যে দুর্বলতা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নানা ঘাটতি সেসব কাটিয়ে উঠতে প্রতিষ্ঠানটি ঠিক কী করছে?
দুদক কেন ব্যাপক দুর্নীতি রোধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না? এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অবশ্য দুদক চেয়ারম্যান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানটির একজন কমিশনার বিবিসিকে সাক্ষাৎকারের জন্য সময় দিয়েও পরে সেটি বাতিল করেন।
তবে দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান অবশ্য বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা কিংবা আইনি প্রতিকারের ক্ষেত্রে কারো কোনো চাপ নেই।
মি. খান বলেন, “দুদক অবশ্যই স্বাধীন। যদি দুদক স্বাধীন না হতো, তাহলে তো তারা আমাকে এ ধরনের মামলা দিতে পারতো না। সরকারি দলের মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া’র মামলা, হাজী মো. সেলিমের মামলা -এসব তো হয়েছে এবং চলছে। ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের পর দুদক অনেক মামলা করেছে, অনেক মামলা এখন নিষ্পত্তির পর্যায়ে আছে। তারা সরকারের আমলা কিংবা অন্য গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল। তাদের হাত অনেক লম্বা, চাইলে প্রভাব বিস্তার করতে পারতো। কিন্তু সেটা কি হয়েছে?”
সরকারবিরোধী ব্যক্তি কিংবা সরকারের ‘সুনজরে’ নেই এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই মামলা হচ্ছে এমন অভিযোগও নাকচ করেন তিনি।
“দেখুন, গত একবছরের তথ্য বিশ্লেষণ করুন, এ ধরনের কোনো দুর্নীতির মামলা হয়নি কোনো বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে। যাদের বিরুদ্ধে হয়েছে, তারা কারা? তারা সবাই পাবলিক সার্ভেন্ট। এখানে সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধেও অনুসন্দান চলছে।”
দুদক আইনজীবী এমনকি খোদ দুদকও বিভিন্ন সময় বলছে, কোনো চাপ ছাড়াই প্রভাবশালীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এসব দুর্নীতি আগে থেকেই প্রতিরোধ করতে পারেনি দুদক।
বরং প্রভাবশালী রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের বিরুদ্ধে এর আগে বেশ কয়েকবার দুদকে অভিযোগ জমা পড়লেও তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ নেই বলে একরকম ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দিয়েছিলো প্রতিষ্ঠানটি। আবার অন্যের দুর্নীতি ধরতে গিয়ে খোদ দুদকেরই কোনো কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন এমন অভিযোগও আছে।
তাছাড়া দুদক যে সরকারের ইচ্ছার বাইরেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে সেরকম কোনো বড় নজিরও নেই। সবমিলিয়ে দুদক কতটা স্বাধীনভাবে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আপনার মতামত জানানঃ